এবছর পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারের কলকাতা-যোগ! হিন্দু স্কুল-প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী অমল রায়চৌধুরীর কথা জানেন?
মহাবিশ্বের অন্যতম রহস্যময় বিষয়ের উদ্ভাবনায় এবছর পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পেলেন তিন গবেষক, ব্রিটেনের রজার পেনরোজ, জার্মানির রেইনহার্ড গেঞ্জেল এবং আমেরিকার আন্দ্রেয়া ঘেজ। ব্ল্যাক হোল সংক্রান্ত গবেষণার জন্য এবার পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পেলেন তাঁরা।
মঙ্গলবার নোবেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নোবেলের একটি অংশ পাচ্ছেন ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক রজার পেনরোজ। অঙ্ক ব্যবহার করে ৮৯ বছরের এই বিজ্ঞানী প্রমাণ করেছেন যে, আপেক্ষিকতাবাদের সাধারণ তত্ত্বের প্রত্যক্ষ পরিণতি হল ব্ল্যাক হোল। ১৯৬৫ সালে সেই গবেষণার ব্যাখ্যা করেছিলেন পেনরোজ। এতদিনে সেই গবেষণার স্বীকৃতি পেলেন তিনি।
কিন্তু জানেন কি পেনরোজের এই গবেষণার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলার এক গবেষক?
সাধারণ আপেক্ষিকতায় পেনরোজ-হকিং সিঙ্গুলারিটি তত্ত্বগুলো প্রতিপাদনের জন্য সাহায্য নিয়েছিলেন এক বাঙালি বিজ্ঞানীর গবেষণালব্ধ সমীকরণের? হ্যাঁ, তাঁর নাম অমল কুমার রায়চৌধুরী। বিশ্বতত্ত্ব-সম্পর্কিত আধুনিক গবেষণায় যাঁর আবিষ্কৃত সমীকরণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। পদার্থ বিজ্ঞানে যা ‘রায়চৌধুরী সমীকরণ’ নামে পরিচিত।
ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হলেন অমল কুমার রায়চৌধুরী। ১৯২৩ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ছোট থেকেই অমলের প্রবল আগ্রহ গণিতে। কঠিন অঙ্কের সমস্যা সমাধান করতে দারুণ ভালোবাসতেন তিনি। সেই ছোটবেলাতেই বরিশাল থেকে কলকাতায় চলে আসে অমলের পরিবার। তাই স্কুল ও কলেজ জীবন কাটে এই কলকাতাতেই। প্রথমে হিন্দু স্কুল এবং তারপর প্রেসিডেন্সি কলেজ। ১৯৪২ সালে প্রেসিডেন্সি থেকে বিএসসি পাশ করে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। তারপর ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স (আইএসিএস)-এ যোগ দেন। কিন্তু দীর্ঘ চার বছর গবেষণা করেও কোনও তাৎপর্যপূর্ণ ফলাফল বের করতে না পেরে প্রচণ্ড হতাশ হয়ে পড়েন তিনি। সে সময় আশুতোষ কলেজে অধ্যাপক এন আর সেন সেখানে আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব পড়াতেন। অমল অধ্যাপক সেনের সান্নিধ্যেই আপেক্ষিকতা তত্ত্ব শিখতে শুরু করলেন নতুন করে এবং তাঁর সাহায্যেই প্রথম কয়েকটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। পরে তিনি একাই গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকেন। গবেষণার একপর্যায়ে এসে তিনি সেই বিখ্যাত সমীকরণ আবিষ্কার করলেন যা থেকেই উঠে আসে পেনরোজ- হকিং সিঙ্গুলারিটি থিওরেম।
অমল কুমার রায়চৌধুরী এই সমীকরণ ১৯৫৩ সালে বের করলেও এটি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ হয় ১৯৫৫ সালে। তাঁর এই গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় বিখ্যাত জার্নাল ফিজিক্যাল রিভিউয়ে। এই গবেষণা প্রবন্ধের হাত ধরেই অমল রায়চৌধুরী আন্তর্জাতিক পরিচিতি পান। যদিও তখনও তিনি ডক্টোরেট ডিগ্রি অর্জন করেননি। তাঁর পিএইচডি সমাপ্ত হয় ১৯৫৯ সালে।
কী ছিল তাঁর এই গবেষণায়?
বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের দেওয়া ব্যাখ্যায়, মহাকর্ষ একটি সম্পূর্ণ জ্যামিতিক ব্যাপার। কিন্তু সেই জ্যামিতিক বৈশিষ্ট্যের কোথায় আকর্ষণধর্মিতার ব্যাখ্যা লুকিয়ে আছে? ‘রায়চৌধুরী সমীকরণ’ থেকেই এর একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। কোনও ধরনের বলের প্রভাব ছাড়া একটি বস্তু যে পথে চলাচল করে, তাকে বলা হয় জিওডেসিক। গবেষক রায়চৌধুরী দেখান, যে কোনও ভারী বস্তুর উপস্থিতিতে তার আশপাশের জিওডেসিকগুলো বস্তুটির দিকে বেঁকে যায়। এটাই মহাকর্ষের আকর্ষণধর্মিতার ব্যাখ্যা দেয়।
একজন মেধাবী বিজ্ঞানী হওয়ার পাশাপাশি অমল কুমার রায়চৌধুরী ছিলেন একজন প্রাণবন্ত শিক্ষক। ক্লাসে তাঁর কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতেন পড়ুয়ারা। মৃত্যুর মাত্র এক বছর আগে তাঁর শেষ গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়। বই পড়তে ভালোবাসতেন তিনি, ছিলেন রবীন্দ্রসংগীতের ভক্ত। রাজনীতিতেও আগ্রহ ছিল তাঁর। প্রত্যক্ষ অংশ না নিলেও বিভিন্ন প্রবন্ধে নিজের রাজনৈতিক মতাদর্শের কথা উল্লেখ করেছেন। কর্মনিষ্ঠ এই বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানীর মৃত্যু হয় ২০০৫ সালের ১৮ জুন।
২০২০ সালে বিজ্ঞানী পেনরোজের পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার লাভ আরেকবার প্রমাণ করল বিজ্ঞানী অমল কুমার রায়চৌধুরীর গবেষণার স্বার্থকতা।
Comments are closed.