৩০ শে জুলাই, সকাল ১০টা। অসমে প্রকাশিত হয় পূর্ণাঙ্গ নাগরিকপঞ্জির খসড়া। তার আগে থেকেই ভয়-ভীতি তৈরি হচ্ছিল ধীরে ধীরে। প্রায় তিন বছরের বেশি সময় ধরে এই পরীক্ষার উত্তর লিখতে হয়েছে সবাইকে। ‘লিগেসি’ ডাটা খুঁজতে হয়েছে। এই পুরো দক্ষযজ্ঞর ফলাফল বেরোলে দেখা গেছে যে, ৪০ লক্ষ লোকের নাম লিস্টে নেই। ৪০ লক্ষ সংখ্যাটাকে একটু কনটেক্সট এ ফেলা যাক। উইকিপেডিয়া বলছে, বিশ্বের ১০০ টা দেশের জনসংখ্যা ৪০ লক্ষের থেকে কম। এবং বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের এই ৪০ লক্ষ লোক, যারা অন্তত কয়েক দশক ধরে ভারতে বসবাস করছে, তাদের গায়ে রাতারাতি বাংলাদেশি তকমা জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আর তারপরই অসমে শুরু হয়ে গেছে অসমীয়া উগ্র জাতীয়তাবাদের পাশবিক উল্লাস।
একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক! অসমে বাঙালি বিদ্বেষ নতুন ঘটনা নয়। ১৯৬১ সালের ভাষিক আগ্রাসন থেকে শুরু করে ২০১৮ র উন্মত্ততা অব্দি প্রায় অবিচ্ছিন্ন সূত্র। ১৯৮৩ তে মধ্য অসমের নগাওঁ জেলার নেলিতে গণহত্যা হয়েছিল। আর ১৯৮৩ তেই সংসদে পাস হয়েছিল আইএমডিটি আইন। দীর্ঘ কুড়ি বছর অসমে, বিদেশি শনাক্তকরণের জন্য এই আইন বলবৎ ছিল। এই আইন অনুযায়ী, অ যদি ব এর বিরুদ্ধে বিদেশি হওয়ার অভিযোগ করে, তাহলে অভিযোগ প্রমাণ করার দায়িত্ব অ এর উপর ন্যস্ত। এর ফলে অসমীয়া উগ্র জাতীয়তাবাদীদের হয়েছিল মহা মুশকিল! খেয়াল খুশি মতো যাকে তাকে ধরে বিদেশি বলা যাচ্ছিল না! আর গণহত্যা একটা হয়েছে বটে, কিন্তু মানুষ মারা তো একটা ঝামেলা সাপেক্ষ ব্যাপার! তাই সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে ২০০৫ সালে এই আইনটা বাতিল করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে প্রশান্ত ভূষণের মন্তব্য খুঁজে দেখতে পারেন। আর এই মামলাটা করেছিলেন সর্বানন্দ সোনওয়াল। হ্যাঁ, সেই সর্বানন্দ সোনওয়াল, যিনি এখন অসমের মুখ্যমন্ত্রী। এবং এই সর্বানন্দ সোনওয়াল সরকারের রাজ্যেই এখন ৪০ লক্ষ মানুষ, যাদের সিংহভাগই বাঙালি, মানবিক এবং ন্যায় বিচারের দুরাশা করছে!
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদী বরাক উপত্যকায় এসে ডিটেনশন ক্যাম্প গুড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। সবার সামনে হিন্দু নাগরিকত্ব বিলের গাজর ঝুলিয়ে গিয়েছিলেন। অসহায় মানুষ সেই টোপ গিলেছে। বিশ্বাস করেছে ‘ন হিন্দু বিদেশি ভবেৎ।’ বিশ্বাস করেছে, ‘বিজেপি এ কিচ্ছু একটা তো করবোউ হিন্দুরার লাগিয়া।’ ভেবেছে যে, মিয়াকে বাঁচানো না গেলেও কিন্তু হিন্দুগুলো অন্তত বাঁচুক। বাঙালি ঐক্য তৈরি না হয়ে বাঙালি হিন্দু-মুসলমান বিভেদকে উস্কে দিয়ে বিজেপি অসমের বঙালি খেদার মূল হোতার সাথে সম্পর্ক জুড়েছে। এর ফল, আজকের ৪০ লক্ষ লোকের হাহাকার, যা আসুর মিষ্টি বিতরণের উল্লাসে চাপা পরে যাচ্ছে।
৩০শে জুলাই ইনস্টিটিউটে দাঁড়িয়ে নাম খুঁজছিলাম। ২১ সংখ্যার নম্বর টিপে ভাগ্য-যাচাই। বাড়িতে ফোন করে শুনলাম, পরিচিত এক ভদ্রমহিলা এই দুর্ভাগা ৪০ লক্ষের মধ্যে এক। অপরাধ, যে বামুন বাড়িতে বিয়ে হওয়ার ফলে বিয়ের পর পিতৃদত্ত নাম পাল্টে দেওয়া হয়েছিল, তাই তিনি যে তাঁর পিতার সন্তান এটা প্রমাণ করা যাচ্ছে না। এফিডেফিট দিয়েছিলেন, নাকচ হয়েছে। আত্মীয়স্বজন এসে শনাক্ত করেছে, তাতেও হয়নি। এখন সেই মাঝ বয়সী মহিলা, যাঁর জন্ম ভারতে, তাঁকে রাষ্টের কাছে আবারও পরীক্ষায় বসতে হবে। এই যে ৪০ লক্ষ লোকের কথা বলা হচ্ছে, এদের বেশির ভাগই নিম্ন-মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত বাঙালি। মধ্যবিত্তদের শিক্ষা এবং অর্থের বর্ম আছে। আমরা কেস লড়তে পারবো, আমাদের কাছে চাকুরির খাতিরে বান্ডিল বান্ডিল নথিপত্র। তবে যিনি রিকশা চালক, যিনি মুচি, যিনি আয়া দাদুর শুশ্রূষা করেন, তারা কী করবেন? তাঁরা তো অনাহারের সাথে লড়াই করা জানেন, কিন্তু যে আইন এবং দস্তাবেজের লড়াইয়ে তাঁদের ছুড়ে ফেলা হয়েছে, সেটা কী করে করবেন? তাঁদের কাছে পড়াশোনার নথি নেই, প্রচুর লোকের জন্মের পরিচয়পত্র নেই এবং থাকলেও তা ভুলে ভরা কারণ তিনি লেখাপড়া জানেন না। ৭১ এর আগের জমির পাট্টা নেই, কারণ থাকলে নিশ্চয়ই লোকের বাড়ি কাজ করে বা মজুরি খেটে খেতে হতো না। সেই লোকগুলোর প্রথম অপরাধ, এরা গরিব এবং দ্বিতীয় গুনাহ এরা বাঙালি। এরকম প্রচুর লোক, ধর্ম নির্বিশেষে আত্মঘাতী হয়েছে। যার রাতে শুয়ে পর দিন চাল কেনার ভাবনা ভাবতে হয়, তার কাছে নথি-পত্র সংগ্রহ করার এলেম না থাকারই কথা। যাঁরা বেঁচে আছেন এখনও, তাঁদের এখন ‘ভগবান ভরসা।’ যা বছর ধরে হয়নি, তা যদি এক মাসে হয়! খড়কুটো আঁকড়েও তো লোকে বাঁচতে চায়! কেন্দ্র চাইছে, যাদের নাম আসেনি তাদের বায়োমেট্রিক ছাপ সংগ্রহ করে রাখতে যাতে এরা পালিয়ে যেতে না পারে। টাকা বরাদ্দ হচ্ছে আরও আরও ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি করার জন্য।
কাল খবর এলো, মেঘালয় সীমান্তে খাসি ছাত্র সংস্থা অসম থেকে আসা গাড়িতে তল্লাশি চালাচ্ছে। যাঁদের কাছে নথি নেই তাঁদের একজনকে পিটিয়েছে। চাকরির খাতিরে আমার সপ্তাহে দুবার গুয়াহাটি-শিলং করতে হয়। তাই নিজের নামের পাতাটা প্রিন্ট করে ব্যাগে রাখলাম। ত্রিপুরার সহকর্মী ঠাট্টা করে বলছিল, গলায় ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সিনেমায় বার বার একটা দৃশ্য ফিরে আসে। জার্মান পুলিশ রাস্তা আটকে ইহুদিদের কাগজ পরীক্ষা করছে। আজকে একই দৃশ্য অভিনীত হচ্ছে, খালি স্থান-কাল-পাত্রের তফাত!
আমার নাম-হারানো, সব খোয়ানো স্বজনরা আজ ‘ভগবানে’র উপর সব ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁরা মানতে পারছেন না এখনও যে, “আকাশে বসত মরা ঈশ্বর।”
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)