এক বছর আগে খুন হয়েছিলেন সাংবাদিক এবং রাইজিং কাশ্মীরের সম্পাদক সুজাত বুখারিঃ ‘সুজাত বুখারি আদতে একটি বুখারের নাম’ লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করা হল
সুজাত বুখারি চলে গেলেন। জম্মু ও কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরের সাংবাদিকদের খাস তালুক বৃহস্পতিবার সন্ধেয় একেবারে মগের মুলুক হয়ে উঠল। আজ বাদে কাল ইদুল ফিতর। ভাইবেরাদরিদের ডাকে ইফতারে যাওয়ার পথে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে মারা গেলেন এই ডাকাবুকো সাংবাদিক। ইদানীং শুধু ‘রাইজিং কাশ্মীর’-এর সম্পাদনার সুবাদে নয়, সুজাতকে আমরা দেখেছি কাশ্মীরের আঁতের কথা বলতে। বারে বারে। দিল্লিশাহিকে রেয়াত না করে, জঙ্গিদের রেয়াত না করে কাশ্মীরের আম আদমির কথা বলতে কোনওদিন পিছপা হননি সুজাত। মোদিশাহির চোখে চোখ রেখে যুক্তি সাজাতে তাঁর বাধেনি। শিয়রে শমন জেনেও হরেক রকমের জঙ্গিদের কালাপাহাড়ি কাণ্ডকেও তুলোধোনা করতে তাঁর আটকায়নি। ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের হরেক কিসিমের উদ্যোগ আয়োজনে তাঁকে লাগাতার সামনের সারিতে দেখা গেছে। সত্যি বলতে কী সঞ্জয় কাকের মতো দু’একজন ছাড়া আজকাল আর কোনও কাশ্মীরির কথা এত দাগ কাটেনি আমাদের মনে। অরুন্ধতী রায়ের মতো দু’একজনকে বাদ দিলে কাশ্মীরের জন্য আর কারওর উথলে ওঠা দরদ আমাদের এত নাড়া দেয়নি।
তাই ইদের চাঁদ দেখার দেবার একদিন আগে কাশ্মীরের মাটিতে তাঁর রক্ত পড়তে দেখে আমাদের যদি টনক না নড়ে তাহলে ভুল হবে। কাশ্মীরে গুলির শব্দ কাল আরও হয়েছে। জায়গায় জায়গায়। সেনাবাহিনী নিকেশ করেছেন দুই জঙ্গিকে। সেনাবাহিনীর এক জওয়ানকে তুলে নিয়ে গিয়ে কোতল করেছে জঙ্গিদের কেউ। রাষ্ট্রপুঞ্জের এক প্রতিবেদনে গেল দু বছরে কাশ্মীরের বুকে ভারত রাষ্ট্রের মাতব্বরি যে বাড়াবাড়ির সীমা লঙ্ঘন করে সেদিকে আঙুল তোলা হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে। বস্তুত খুনখারাপির এই নন্দনকাননে শান্তিপ্রতিষ্ঠা করতে যাওয়া কতক উইন্ড মিলের সঙ্গে দন কিহোতের লড়াইয়ের সামিল।
তবু সব মরণ নয় সমান।
কারণ সুজাত বুখারির খুন একাধারে গণমাধ্যমের টুঁটি টিপে ধরা ও মুক্তচিন্তকদের পিষে মারার সমার্থক। আমাদের কপালের ভাঁজ আরও দীর্ঘ হচ্ছে কারণ মোটের ওপর একই তরিকায় সাংবাদিক আর মুক্তচিন্তকদের খুনের সিলসিলা জারি হয়েছে এই ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে।
বেশি পেছনে যাবার দরকার নেই। দিন সাতেক আগেই বাংলাদেশের এক বামপন্থী সাংবাদিক তথা প্রকাশককে খুলে আম কোতল করা হয়েছে। সামান্য পিছোলেও রাজীব হায়দার, অভিজিৎ রায় এমন অনেক নাম মনে পড়বে। কেউ ধর্মের ওপরে বিজ্ঞানকে রাখতে চেয়েছেন বলে চাপাতির কোপ খেয়েছেন। কেউ শিক্ষা-অশিক্ষার ফারাক ধরিয়ে দিয়েছেন। কেউ লিঙ্গগত প্রান্তিকতাকে নিজের মতো করে উদ্যাপন করেছেন। কেউ সেই সব তথাকথিত ‘প্রগতিশীল’ বই ছেপেছেন। তাই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ঠিকেদারি নেওয়া কিছু সংগঠন তরুণ প্রজন্মের লাখো যুবককে এক ধরনের শিবিরে টেনে এনে একই ক্ষুরে মাথা কামিয়ে দিয়ে ধড়-মুণ্ডু আলাদা করার বিদ্যে শেখাচ্ছে। ধরপাকড় হচ্ছে না এমন নয়। মাস তিনেক আগে সিলেটের বুকে বাংলাদেশের প্রথম সারির অধ্যাপক ও বিজ্ঞানলেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালকে পেছন থেকে ছুরি মেরেছিল এক গোবেচারা ছোকরা। সে বেচারি ধর্মশিক্ষার চৌকাঠ পেরোতে পারেনি। কী কুক্ষণে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পড়েছিল কে জানে! যাঁকে মারতে গেছিল তাঁর ব্যাপারে কিছুই জানত না সে। তবু জান কবুল করে এগিয়ে গেছিল। এই খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তেই স্মার্টফোনে বাংলাদেশের একটি নিউজ চ্যানেলের লাইভ টেলিকাস্ট দেখছিলাম। তাতে বন্যার জলের মতো কমেন্ট ভেসে আসছে। বারো আনা কমেন্টেই বিজ্ঞানপ্রবরকে শমনভবনে পাঠানোর আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হচ্ছে। যে ভাষায় যে ভঙ্গিতে এই খুনখারাপির সংস্কৃতি সেদিন নিজেকে জাহির করেছিল তার সঙ্গে সম্মান সংবিধান সভ্যতার তিলমাত্র সম্বন্ধ নেই।
বৃহস্পতিবার রাত থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে ভাষায় সুজাত বুখারির সহমর্মীদের গায়ে দেশদ্রোহীর মোহর লাগানোর খেল চালু হয়েছে তাও সমান উদ্বেগজনক। বেঙ্গালুরুতে গেল বছর খুন হয়েছেন আর এক একরোখা সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ। অপরাধ? হিন্দুত্ববাদীদের নীল নকশা ক্রমাগত ফাঁস করে যাওয়া। অপরাধী ধরার নামে বাঘবন্দি খেলা এখনও চলছে। একইভাবে খুন হয়েছেন দুই মুক্তচিন্তক নরেন্দ্র দাভোলকর ও গোবিন্দ পানসারে। শিবাজি মহারাজকে ধৌত তুলসীপত্র প্রমাণ করতে যারা বদ্ধপরিকর তাদের কোপে পড়েছেন দ্বিতীয় জন। দ্বিতীয়জন গুনেছেন সঙ্ঘ পরিবারের স্যাঙাতদের সামনে বুক ঠুকে বেড়ানোর মাশুল। এও অদ্ভুত যে এদেশে হোক বা প্রতিবেশী দেশে, এমনকী পাকিস্তানেও, রাষ্ট্র এইসব দুষ্কৃতীদের দমন করার কসম খেলেও আড়ালে আবডালে তাদের সঙ্গে সমঝোতা করেই গদিয়ান রয়েছে। এই তো সেদিন প্রবীণ কবি শঙ্খ ঘোষকে জনসমক্ষে নস্যাত করে দিলেন শাসক দলের এক জেলা সভাপতি। এমনতর মাতব্বরের বাড়বাড়ন্ত আমাদের চোখ এড়াচ্ছে না। এদের চড়াম চড়াম ঢাকের আওয়াজ আমাদের পিঠে বাজছে না এমনটাও নয়। তবু এদের সঙ্গেই আঁতাত করে চলছে প্রশাসন।
এদের ধ্বজাধারীদের ‘লুম্পেন’ বলে দাগিয়ে দিলে ল্যাঠা চুকে যায় না। এদেরকে ‘ছোটলোক’ বলে নামিয়ে দিলে প্রকারান্তরে বক্তার অসহায়তাই প্রকাশ পায়। এদের চমক ধমক বরকরার থাকে। এদের এক মুখপাত্র আদ্যিকালে ইন্টারনেট ছিল বলে মহাভারতের সঞ্জয়কে উকিল ঠাউরে বসেন। কেউ ‘বিরোধীশূন্য’ করার হাঁক দেন। এদের এক মুখপাত্র পান থেকে চুন খসলেই জেহাদের হুঁশিয়ারি দেন। এদের একদল রামকে সামনে রেখে তলোয়ার উঁচোন তো আর এক দল গলির মোড়ে মোড়ে হনুমানকে ছাতি ফুলোনোর রাস্তা বাতলে দেন। এসবের পেছনে সাধারণ কৌম সংস্কৃতির গাঁটছড়া থাকলে কিছু বলার থাকত না। এসবের পেছনে কেবলই ক্ষমতা দখলের খেলা থাকায় কপালের ভাঁজ বাড়ে। রক্তবীজের মতো গজাতে থাকে ধর্মান্ধ প্রজন্ম। অভিজিৎ রায় বা সুজাত বুখারির মতো যাঁরা দক্ষিণ এশিয়ার রন্ধ্রে রন্ধ্রে চারিয়ে যাওয়া অসহিষ্ণুতার সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ান ক্ষমতাতন্ত্র তাঁদের কোনও না কোনওভাবে পথের কাঁটা বানিয়ে নেয়। তারপর পিষে মারে। যুক্তিবাদের জ্ঞানচর্চার বুখার সারানোর জন্য দাওয়াই দেয় কার্তুজে, কাটারিতে। মধ্যযুগীয় বর্বরতার ছবি ফুটে ওঠে আমাদের এলইডি স্ক্রিনে। রোজ। কোথাও না কোথাও।
আসলে যুদ্ধটা এখন তুঙ্গে চলে গেছে। আর এটাও বুঝে নিতে হবে যে যুদ্ধটা আজ দাঙ্গাবাজ আর ঝান্ডাবাজদের মধ্যে নেই। রাষ্ট্র আর রাষ্ট্রদ্রোহীদের মধ্যেও নেই। কে ফ্যাসিবাদী, কে মার্কসিস্ট, কে লিবার্যাল সে প্রশ্নও এখন গৌণ। যুদ্ধটা এখন সভ্যতার সঙ্গে অসভ্যতার। আলোর সঙ্গে অন্ধকারের।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Comments are closed.