সুভাষ কাপুরের জলি এলএলবি ছবিতে একটি ডায়লগ ছিল, ‘আইন অন্ধ ঠিকই কিন্তু বিচারক নন। তিনি সব দেখতে পান’। পাটনা হাইকোর্টের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে কি সেই ইঙ্গিত? সমস্যার সূত্রপাত ২০ পাতার একটি রায়কে কেন্দ্র করে। নজিরবিহীনভাবে পরদিনই যে রায়কে খারিজ করে দেয় পাটনা হাইকোর্টের ১১ বিচারপতির বেঞ্চ। বিচারপতি রাকেশ কুমারের সেই রায় একদিকে যেমন হইচই ফেলে দিয়েছে দেশের আইন মহলে, অন্যদিকে তুলে দিয়েছে বহু প্রাচীন কিন্তু প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন, বিচারবিভাগ কি দুর্নীতির আঁতুড়ঘর?
বিতর্কের সূত্রপাত গত ২৮ শে অগাস্ট। ৫ কোটি টাকা দুর্নীতি মামলায় বিহারের প্রাক্তন আমলা কে পি রামাইয়াকে নিম্ন আদালতের জামিন দেওয়া নিয়ে একটি সুয়ো মোটো মামলা শুনছিলেন বিচারপতি রাকেশ কুমার। সুপ্রিম কোর্ট এবং হাইকোর্ট আগাম জামিন খারিজ করার পর অবসরপ্রাপ্ত আমলা নিম্ন আদালত থেকে জামিন পান। আর এখানেই প্রশ্ন তোলেন বিচারপতি কুমার। ২০ পাতার দীর্ঘ রায়ে তিনি লেখেন, জামিন দেওয়া কিংবা খারিজ করা আদালতের এক্তিয়ার। কিন্তু যেভাবে এই মামলায় জামিন দেওয়া হয়েছে, তা বিচারব্যবস্থাকে গুরুতর প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। আদালত জানতে চায়, জামিন কি আইনের ভিত্তিতে দেওয়া হয়েছে, নাকি বাইরের কোনও প্রভাবে? আমার মতে এই ঘটনার তদন্ত হওয়া উচিত। তদন্ত করুন পাটনার জেলা জজ। সংবাদপত্রে বেরিয়েছে, নিয়মিত বেঞ্চ সেই সময় ছুটিতে ছিল। এটা কি সত্যি? যদি নিয়মিত বেঞ্চের বদলে ভেকেশন বেঞ্চ জামিন মঞ্জুর করে, তাহলে সেই বিচারকের শেষ ৬ মাসের কাজকর্ম খতিয়ে দেখা হোক। স্পেশাল বেঞ্চের বিচারক আচমকা এই সময় কেন ছুটিতে? নাকি বিশেষ কোনও কারণে ওই সময় তিনি ছুটিতে ছিলেন? রায়ে তিনি বিচারব্যবস্থায় দুর্নীতির বেশ কয়েকটি অভিযোগ করেন। পাশাপাশি দীর্ঘ রায়ে বিচারপতি রাকেশ কুমার লেখেন, সাধারণত আমি এই ধরনের রায় দিই না। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে এই কোর্টে (পাটনা হাইকোর্ট) সব কিছু ঠিকঠাক চলছে না। ২০০৯ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর ন্যায় দেওয়ার শপথ নিয়েছিলাম। তাই যদি আমি দুর্নীতি মামলায় পদক্ষেপ নিতে না পারি, তাহলে সেটা নিজের জন্যও ন্যায় করা হবে না। কীভাবে বিচারব্যবস্থা দুর্নীতিগ্রস্থদের রক্ষাকবচে পরিণত হয়েছে, উদাহরণ সহকারে তাও লেখেন বিচারপতি কুমার। ঘটনায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়ে তিনি রায়ের কপি পাঠান সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি, সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়াম, পিএমও, আইন মন্ত্রক এবং সিবিআইয়ের ডিরেক্টরকে।
এই রায়ের পরই শোরগোল পড়ে যায়। পাটনা হাইকোর্টের সবচেয়ে সিনিয়র বিচারপতির এই রায়ের প্রেক্ষিতে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বৈঠকে বসেন পাটনা হাইকোর্টের বিচারপতিরা। ১১ জন বিচারপতির বেঞ্চ জাস্টিস রাকেশ কুমারের রায়কে সাসপেন্ড করে। তাঁর হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হয় সমস্ত মামলা। ১ লা সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করেন বিচারপতি রাকেশ কুমার এবং পাটনা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি এ পি শাহি। তারপর অবশ্য তাঁকে মামলা ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে খবর।
পাটনা হাইকোর্টের এই ঘটনায় সারা দেশে সাড়া পড়ে যায়। বিচারপতি রায়ে কেন একথা লিখলেন? তাহলে কি জলি এলএলবি সিনেমার জজের মতোই রাকেশ কুমারও কিছু ‘দেখতে’ পেয়েছিলেন? পাটনা হাইকোর্টের সবচেয়ে সিনিয়র বিচারপতি রাকেশ কুমারের পরিচিতি নিজের সততা এবং ডাকাবুকো মনোভাবের জন্য। পশুখাদ্য কেলেঙ্কারিতে সিবিআইয়ের আইনজীবী হিসেবে তাঁর সওয়াল জনমানসে দাগ কেটেছিল।
এর আগে বিচার বিভাগের কর্ম পদ্ধতি নিয়ে অসন্তোষ ব্যক্ত করে বেনজিরভাবে সাংবাদিক বৈঠক করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র বিচারপতিরা। অবসর নিয়ে বিচার বিভাগের দুর্নীতি নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করেছিলেন বিচারপতি জোসেফ কুরিয়েন। সদ্য মাদ্রাজ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে মেঘালয় হাইকোর্টে বদলি করার সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে চাকরি থেকেই ইস্তফা দেন ভি তাহিলরামানি। এবার পাটনা হাইকোর্টের সিনিয়র মোস্ট বিচারপতি রাকেশ কুমার আঙুল তুললেন বিচার ব্যবস্থার সততা নিয়ে। বিচারপতির এমন বিস্ফোরক রায় এবং পরে তা বাতিল হলেও স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠা ঠেকানো যাচ্ছে না।
Comments are closed.