দেশের ১ শতাংশ ধনীর হাতে জাতীয় আয়ের ২১.৭ এবং সম্পদের ৬০ শতাংশ, রাজ-আমলের থেকেও ভারতে আজ বেশি বৈষম্যঃ প্রভাত পট্টনায়ক
রাজা-রাজড়ার আমলে ধনী-গরিবে ফারাক ছিল সবচেয়ে বেশি, কিন্তু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর এই ফারাক কমতে থাকে। এমনটাই প্রচলিত ধারণা। কিন্তু জানেন কি, রাজা-মহারাজাদের আমলের চেয়েও বর্তমান ভারতে বৈষম্য অনেকটাই বেশি? অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, মোদীর নিউ ইন্ডিয়ায় ধনী-গরিবে ফারাক বাড়তে বাড়তে তা ছাপিয়ে গিয়েছে রাজা-মহারাজাদের আমলকেও।
৩০ শে জুন সিপিএমের মুখপত্র পিপলস ডেমোক্রেসিতে একটি প্রতিবেদন লিখেছেন অর্থনীতিবিদ প্রভাত পট্টনায়ক। সেখানেই গোটা বিশ্বের আয়ের বৈষম্য দেখানোর পাশাপাশি তিনি বিশ্লেষণ করেছেন ভারতের বর্তমান আর্থসামাজিক চালচিত্রকেও। সেখানেই উঠে এসেছে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য।
গোটা বিশ্বেই বৈষম্য বাড়ছে। ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়। পিপলস ডেমোক্রেসি’তে প্রভাত পট্টনায়ক লিখেছেন, আশ্চর্যজনকভাবে ধনের অসম বণ্টন নিয়ে ভারতে সবাই চুপ। এটা যেন কোনও বিতর্কের বিষয়ই নয়, অথচ এখানেই বৈষম্য সবচেয়ে বেশি করে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। প্রতিবেদনে অধ্যাপক পট্টনায়ক ফরাসি অর্থনীতিবিদ থমাস পিকেটি এবং প্যারিস স্কুল অফ ইকনমিক্সের লুকাস চ্যানসেলের একটি সমীক্ষার কথা তুলে ধরেছেন। আয়করের তথ্য থেকে তৈরি করা সেই রিপোর্টে পিকেটি এবং চ্যানসেল দেখিয়েছেন, কীভাবে দেশের ধন-সম্পত্তি বণ্টনে বৈষম্য থাবা বসাচ্ছে। ২০১৩-১৪ সালের আয়কর তথ্য খতিয়ে দেখে দুই অর্থনীতিবিদ জানিয়েছেন, দেশের সুপার রিচ ১ শতাংশের হাতে মোট জাতীয় আয়ের ২১.৭ শতাংশ সীমাবদ্ধ। ১৯২২ সালে ভারতে ইনকাম ট্যাক্স লাগু হওয়ার পর এই বৃদ্ধি সর্বোচ্চ ২০১৩-১৪ সালে। রাজা-মহারাজাদের আমলেও আয়ের বণ্টনে এতটা বৈষম্য ছিল না, যা ক্রমেই বাড়ছে। বৈষম্যের বৃদ্ধি যে কী ব্যাপক হারে হয়েছে তা বুঝতে গেলে একটি সামান্য উদাহরণই যথেষ্ট। প্রভাত পট্টনায়ক লিখছেন, ১৯৮২ সালে দেশের সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশের হাতে ছিল মোট জাতীয় আয়ের মাত্র ৬.২ শতাংশ। যা ২০১৩-১৪ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ২১.৭ শতাংশে। এই হিসেব থেকেই স্পষ্ট, উদারীকরণের সিদ্ধান্তের ফসল আসলে ঘরে তুলেছেন কেবলমাত্র ওই ১ শতাংশ মানুষই।
একই কথা প্রযোজ্য সম্পদের বৈষম্যের ক্ষেত্রেও। মার্ক্সসিস্ট অর্থনীতিবিদ প্রভাত পট্টনায়ক তাঁর প্রতিবেদনে বলছেন, এই মুহূর্তে দেশে একেবারে উপরের সারিতে থাকা ১ শতাংশ পরিবারের হাতে গচ্ছিত রয়েছে দেশের মূল সম্পদের ৬০ শতাংশেরও বেশি। আর এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধির শুরুটা উদারীকরণের জমানাতেই বলে জানাচ্ছেন প্রভাত পট্টনায়ক। তিনি বলছেন, ভারতের ধন বৈষম্য এই মুহূর্তে লজ্জায় ফেলে দেবে আমেরিকাকেও। কিন্তু তাও এই বিষয় নিয়ে কারও যেন মাথাব্যথাই নেই, আক্ষেপ জেএনইউর অর্থনীতির অধ্যাপকের।
অধ্যাপক পট্টনায়ক লিখছেন, পরিস্থিতি এমনই যে দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের বৈঠকেও এই ক্রমবর্ধমান বৈষম্য নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। বিশ্বের অর্থনীতিতে বেড়ে চলা বৈষম্য গণতন্ত্রের জন্য ভয়াবহ। অধ্যাপক পট্টনায়ক লিখছেন, সাধারণত ধনীদের মঞ্চ থেকে এমন আশঙ্কার কথা বলার তাৎপর্য আলাদা। তিনি বলছেন, বৈষম্য নিয়ে আশঙ্কার কথা জানাচ্ছেন পুঁজিবাদের ধারক-বাহকরাই, এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনা সচরাচর দেখা যায় না।
প্রভাত পট্টনায়কের মতে, আগ্রাসী হিন্দুত্বের স্লোগানের আড়ালে আসলে সুপার রিচদের খুশি করারই নিরন্তর প্রয়াস চলছে মোদী সরকারের অন্দরে। যাতে সুপার রিচ পরিবারগুলোর পাশাপাশি উগ্র হিন্দুত্বের সমর্থকদেরও খুশি রাখা যায়।
কিন্তু এই অবস্থার সমাপ্তি ঘটবে কীভাবে? সেই পথেরও হদিশ দিয়েছেন অধ্যাপক পট্টনায়ক। আরেক মার্ক্সবাদী অর্থনীতিবিদ পোল্যান্ডের মিখাল কালেচি দেখিয়েছিলেন, কীভাবে সম্পত্তি কর বসিয়ে দেশের অর্থনীতির সুষম বণ্টনের ধারা ফিরিয়ে আনা যায়। কিন্তু আমেরিকা থেকে ইউরোপ, প্রথম বিশ্বের দেশে সম্পত্তি করের তীব্র বিরোধিতা এসেছে ধনীদের কাছ থেকেই। ভারতের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হবে না, এটা এখনই বলে দেওয়া যায়। এই প্রেক্ষিতেই পিপলস ডেমোক্রেসির প্রতিবেদনে অধ্যাপক প্রভাত পট্টনায়ক বলছেন, লাগাতার শ্রেণি সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই একমাত্র সম্পত্তি কর বসানোর দিকে যাওয়া সম্ভব।
Comments are closed.