১২০ জন শবর শিশুর অভিভাবকের ভূমিকায় পুরুলিয়ার ভূমিপুত্র কলকাতা পুলিশের ট্রাফিক কনস্টেবল অরুপ মুখোপাধ্যায়।
শহর কলকাতার ব্যস্ত পার্ক স্ট্রিটে সপ্তমীর সন্ধ্যে, ঝলমলে পোশাক পরে কচিকাঁচারা মা-বাবার হাত ধরে চলেছে ঠাকুর দেখতে। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে করতে হঠাৎই অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন কলকাতা ট্রাফিক পুলিশের কনস্টেবল অরুপবাবু। তাঁর তখন মন পড়ে থাকে নিজের পুরুলিয়া জেলার পুঞ্চাতে। সেখানে তাঁর অপেক্ষায় তখন দিন গুনছে ১২০ জন শবর শিশু।
অরুপ মুখোপাধ্যায়, কনস্টেবল কলকাতা পুলিশ
thebengalstory.com কে অরুপবাবু জানালেন, পুরুলিয়ার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শবর শিশুদের শিক্ষার জন্য তিনি ২০১১ সালে গড়ে তুলেছেন পুঞ্চা নবদিশা মডেল স্কুল। পিছিয়ে পড়া জনজাতি বলেই পরিচিত এই শবররা। দারিদ্র্য, কুসংস্কার, অশিক্ষা সমাজের থেকে অনেকটা দূরে ঠেলে দিয়েছে শবরদের। পুরুলিয়ার পুঞ্চাতেই জন্ম এবং বড় হয়ে ওঠা কলকাতা পুলিশের এই কনস্টেবলের। ছোট থেকেই দেখে এসেছেন, শবরদের কীভাবে অপরাধীর তকমা দেওয়া হয়। তাই সংকল্প নিয়েছিলেন, যেভাবেই হোক নিজের জেলার এই মানুষগুলোকে এগিয়ে নিয়ে আসতে হবে। দিতে হবে শিক্ষার আলো, নয়তো আরও অন্ধকারে তলিয়ে যাবে তারা। অরুপবাবু জানালেন, তখন ডিসি সাউথ ছিলেন মুরলিধর শর্মা। সবরকম সহযোগিতা করেছিলেন এই আইপিএস অফিসার। এমনকী স্কুলের প্রয়োজনে পুঞ্চা যেতে হলে মিলত সবেতন ছুটি। অরুপবাবু আরও জানালেন, এই মুহর্তে তাঁর স্কুলে ১২০ জন ছাত্র-ছাত্রী আছে। ২০১৯ সালে মাধ্যমিক দেবে সাধু শবর, নটরাজ শবর এবং জর্জ শবর। নিজের বেতনের টাকা এবং কিছু শুভানুধ্যায়ীর আর্থিক সহযোগিতা থেকেই কোনও মতে চলছে এই আবাসিক স্কুল। সকালে পান্তা খেয়ে পড়তে যায় হতদরিদ্র এই শবর শিশুরা। দুপুর এবং রাতে ডাল, ভাত সবজি। সপ্তাহে দু’দিন ডিম এবং মাসে দু’বার মাংস। এইটুকুই তাঁর সন্তানদের দিতে পারেন। ১২০ জন শিশু কিশোরের কাছে অরুপবাবু এখন ‘পুলিশবাবা’।
মায়ের কাছে ভাত চেয়েছিল বলে কেরোসিন তেল ঢেলে দেড় বছরের কাজল শবর এবং তার দুই দাদা লাদেন শবর এবং বাসুদেব শবরকে পুড়িয়ে দিতে গিয়েছিলেন মা। পুলিশের সহযোগিতায় তাদের উদ্ধার করে নিয়ে আসেন অরুপ। এরপর কেটে গিয়েছে প্রায় দেড় বছর। পুঞ্চা নবদিশা স্কুলেই স্থায়ীভাবে রয়ে গিয়েছে তিন ভাইবোন। শবরদের মধ্যে সতেচনতা গড়ে তোলার কাজটিও অরুপবাবু করে চলেছেন নীরবে। মাগুরিয়া শবরপাড়া, ফুলঝোড় শবর পাড়া, কুলাবহাল শবরপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় অরুপবাবু এবং তাঁর সহযোগীরা নাবালিকা বিবাহ রোধ, শবর শিশুদের টিকাকরণ, অপরাধ না করার জন্য বোঝাচ্ছেন, ফলও মিলছে হাতেনাতে। একটা সময় প্রয়াত লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী শবরদের সমাজের মূল স্রোতে ফেরানোর জন্য নানা উদ্যোগ নিয়ে নিয়েছিলেন। এবার পুরুলিয়া জেলার এক ভূমিপুত্র নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন সেই কঠিন দায়িত্ব।