রঘুরাম রাজন: কর্তব্যপরায়ণ নাগরিক মানে কী, প্রমাণ করছেন দীপিকা পাড়ুকোনরা, সংবিধানের মূল ভাবনা এখনও উজ্জ্বল
জেএনইউতে গিয়ে আন্দোলনরত পড়ুয়াদের পাশের দাঁড়ানো ইস্যুতে দীপিকা পাড়ুকোনের পাশেই দাঁড়ালেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন (Raghuram Rajan)। শুক্রবার নিজস্ব ব্লগে রঘুরাম রাজন লেখেন, বলিউড অভিনেত্রী দীপিকা পাড়ুকোন, নির্বাচন কমিশনার অশোক লাভাসা, আইএএস অফিসার এস শশীকান্ত সেন্থিল, কান্নন গোপীনাথনের মতো ব্যক্তিরা প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, ভারতীয় সংবিধানের মূল ভাবনা এখনও উজ্জ্বল। তাঁরা প্রমাণ করে দিয়েছেন, ‘কর্তব্যপরায়ণ নাগরিক” মানে কী।
জেএনইউ-হামলার পর পড়ুয়াদের পাশে দাঁড়ানোয় তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে দীপিকা পাড়ুকোনকে নিয়ে। ‘টুকড়ে টুকড়ে গ্যাং’-কে সমর্থন করার অভিযোগে দীপিকাকে কাঠগড়ায় তুলেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি শুরু করে থেকে বিভিন্ন বিজেপি নেতা-মন্ত্রী। এ সম্পর্কে অর্থনীতিবিদ রাজন (Raghuram Rajan) লিখেছেন, নিজের সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা বিপদে পড়তে পারে জেনেও, এক শ্রেণির মানুষের বিরাগভাজন হবেন ভেবেও দীপিকা যে জেএনইউ পড়ুয়াদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাঁর এই সাহস প্রশংসনীয়। দীপিকার এই অবস্থান অন্যান্যদেরও উদ্বুদ্ধ করবে।
জেএনইউ হামলা নিয়েও নিজের মনোভাব প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদ (Raghuram Rajan)। ‘এ রেজোলিউশন ফর দ্য নিউ ডিকেড’ শীর্ষক লিঙ্কডিনের ব্লগে তিন লিখেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের যে খবর ভেসে আসছে তা দুশ্চিন্তার তো বটেই। এখনও পর্যন্ত আক্রমণকারীরা স্পষ্ট করে চিহ্নিত না হলেও এটা স্পষ্ট যে আক্রমণকারীরা নির্দিষ্ট একটি দলের কর্মী। আর সরকার বা পুলিশ কেউই এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করেনি। এখানেই থামেননি রাজন। আরও কড়া ভাষায় সরকার ও প্রশাসনের সমালোচনা করে তিনি লেখেন, যখন দেশের নামী বিশ্ববিদ্যালয় কার্যত যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়, সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তারা বিরুদ্ধ মতকে অবদমিত করার চেষ্টা করছে, তখন তা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তিনি এও জানান, কোনও নেতৃত্বকে দোষারোপ করা খুব সহজ, কিন্তু সমাজের প্রতি আমজনতার সমান কর্তব্য রয়েছে, যারা এই নেতাদের নির্বাচিত করে। গণতন্ত্র মানে কেবল অধিকার নয়, কর্তব্যও বটে। শুধু নির্বাচনের সময় নয়, প্রতিদিন দেশের মানুষের এই গণতান্ত্রিক কর্তব্য পালন করা উচিত বলে উল্লেখ করেন রঘুরাম রাজন।
এনআরসি, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন, এনপিআরের বিরুদ্ধে দেশজোড়া আন্দোলন নিয়ে আরবিআই-র প্রাক্তন গভর্নর লিখেছেন, আমাদের মধ্যে কেউ কেউ আশা করি, ক্ষমতাসীন নেতারা দেশের অর্থনীতির উপর জোর দেবেন। কেউ কেউ তাঁদের বক্তব্যকে সমর্থন করেন, কেউ আবার বিরুদ্ধ মত দেন। আবার কেউ কেউ ভয়ে থাকেন, সমালোচক হলে বুঝি তাঁর উপরও খাঁড়া নেমে আসবে। তারপরেও যখন, দেশের যুব সমাজ, সে হিন্দু, মুসলিম যে ধর্মেরই হোক না কেন, জাতীয় পতাকা নিয়ে হাতে হাত রেখে প্রতিবাদে সামিল হন, রাজনৈতিক নেতাদের নিজস্ব স্বার্থে ঘোষিত বিভাজনের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন, তাঁরা বুঝিয়ে দেন দেশের সংবিধানের মূল ভাবধারা এখনও দারুণভাবে উজ্জ্বল।
প্রাক্তন আইএএস অফিসার শশীকান্ত সেন্থিল, কান্নন গোপীনাথনদের উদাহরণ টেনে রঘুরাম রাজন লিখেছেন, যখন সরকারি নীতির সঙ্গে একমত হতে না পেরে নিজেদের স্বপ্নের চাকরি থেকে আমলারা ইস্তফা দেন, তা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। যখন নির্বাচন কমিশনার তাঁর পরিবারের উপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে জেনেও নিজের কর্তব্য পালনে অবিচল থাকেন, প্রমাণ করেন সততা একেবারে বিকিয়ে যায়নি। যখন রাজরোষে পড়বে জেনেও কোনও সাংবাদিক সত্যানুসন্ধানে নিরলসভাবে পরিশ্রম করে যান, তখন তাঁরা বুঝিয়ে দেন, গণতন্ত্রে কর্তব্যপরায়ণ নাগরিকের আসল মানে।
রাজন লেখেন, এই সব মানুষ সেই ভারতের জন্য লড়ছেন, যে দেশের জন্য মহাত্মা গান্ধী প্রাণ দিয়েছেন। তাঁরা এখন স্বাধীনতার জন্য নয়, স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আন্দোলনে করছেন। রঘুরাম তাঁর লেখা শেষ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতার লাইন দিয়ে, ‘নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত করি, পিতঃ; ভারতেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত।’
Comments are closed.