২০১৪ সালের মে মাসে মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রতিটা নতুন দিন দেশের মানুষের জন্য নতুন নতুন দুর্বিষহ পরিস্থিতির জন্ম দিচ্ছে। গত শতকের তিনের দশকের-হিটলারের জার্মানির পুননির্মাণ এর ছবি ভারতবর্ষের পথে প্রান্তরে মাথা তুলছে। লালন কবীরের এই পরমতম সহিষ্ণুতার ভারতবর্ষ গত চার বছর ধরে প্রতিদিন বুঝতে শিখছে, শিখে চলেছে রোজ–এ পান পাত্র নিদারুন বিষে ভরা.’
স্বাভাবিকভাবেই দেশজোড়া বিকল্পের আহ্বান ও সন্ধান প্রতিদিন জোরালো হচ্ছে। দেশের যেখানে যে শক্তিশালী তাকেই বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই নেতৃত্ব দিতে হবে, এই বাস্তবতা প্রতিদিন আরও দৃঢ় হচ্ছে।
আর এই শক্তির নিরিখে বাংলার মাটিতে বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ের প্রধানতম মুখ যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস তা নিয়ে কোনও রকম সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করেই বাংলার সিপিআইএম আহ্বান জানিয়েছে, বিজেপি আর তৃণমূলকে একসাথে হারাবার। আর এই আহ্বানেই ধোঁয়াশা তৈরি হচ্ছে বামেদের সদিচ্ছা নিয়ে। বহু বামপন্থী মানুষও প্রশ্ন তুলেছেন, এই অবাস্তব স্লোগান আদপে বিজেপির হাত শক্ত করবে। সোনার পাথর বাটির মতো এই স্লোগান দিয়ে অস্তিত্ব সংকটে ভোগা সিপিআইএমের লোক হাসানো ভোরবেলায় বনধ চূড়ান্ত ফ্লপ হওয়ার পর এই প্রশ্ন আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। এই লাইন নিয়ে বাংলার সিপিআইএম কি বিজেপির কাছে আত্মসমর্পণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে না? কর্নাটকের আগামী বিধানসভা নির্বাচনে গোটা কুড়ি সিটে প্রার্থী দেওয়ার পর সিপিআইএম ঘোষণা করেছে, বাদবাকি সিটে বিজেপি বিরোধী সবথেকে শক্তিশালী প্রার্থীকেই তারা সমর্থন করবে। মোদ্দা কথায় কংগ্রেসকে সমর্থন করবে। কর্নাটকে যদি বিজেপি বিরোধী সবথেকে শক্তিশালী দল হিসেবে কংগ্রেসকে সমর্থন করা যায়, তবে কোন অঙ্কে বাংলায় তৃণমূলকে সমর্থন করা যাবে না? বিজেপির বিশিষ্ট শুভাকাঙ্খী হিসেবে সিপিআইএমকে চিহ্নিত করতে দ্বিধাবোধ করছেন না সিপিআইএমের কর্মী সমর্থকদের একাংশ। দেশের সমস্ত বিজেপি বিরোধী দল যখন ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের রাস্তা খুঁজছে, তখন তৃণমূল এবং বিজেপিকে একাসনে বসিয়ে দিয়ে সিপিআইএম, ধর্মনিরপেক্ষ মহাজোট গড়ার সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করার ব্যবস্থা করছে।
গত চার বছর ধরে যখন মোদি সরকারের ফ্যাসিবাদী প্রবণতাগুলো স্পষ্ট হয়েছে, তখন দিল্লির একেজি ভবনের ঠান্ডা ঘর থেকে বারেবারেই তাত্ত্বিক নিদান দেওয়া হয়েছে। মোদি সরকার নিয়ে বলা হয়েছে, ‘not fascist but authoritarian.’ ফ্যাসিবাদ না কতৃত্ববাদ, এই তাত্ত্বিক তর্কের মধ্যে আটকে থাকার পর সিপিআইএমের আসন্ন পার্টি কংগ্রেসে সম্ভবত ভোটাভুটির মাধ্যমেই আগামী তিন বছরের লাইন নির্ধারিত হয়ে যাবে। লোকসভায় একক সংখ্যায় নেমে যাওয়া সিপিআইএম তবুও কিছুতেই বাস্তবতাকে স্বীকার করতে রাজি নয়। আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের গজদন্তমিনারের জনবিচ্ছিন্ন তাত্ত্বিক বোদ্ধারা তৃণমূল আর বিজেপিকে একাসনে বসিয়েই যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। আসলে চোখ বন্ধ করে থাকলে তো আর বাস্তব বদলে যায় না,। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে আর শুধু বাংলার নেত্রী নন, তাঁকে কেন্দ্র করে দেশের বিজেপি বিরোধী রাজনীতি যেভাবে আবর্তিত হচ্ছে, তা সূর্যবাবুরা জানেন না, তা নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক দিল্লি সফর বিজেপির রক্তচাপ বাড়িয়েছে, তাই নয়, তৃণমূল নেত্রীকে কেন্দ্র করে সংসদ ভবনে বিজেপি বিরোধী সাংসদদের উৎসাহ সিপিআইএমের সাংসদরাও দূর থেকে বসে দেখেছেন। একটার পর একটা লোকসভা উপনির্বাচনের ফল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে মোদি বিরোধী লড়াইয়ের ঐক্যবদ্ধ চেহারা। পার্থক্য ভুলে এক হয়েছেন বুয়া-ভতিজা। অখিলেশ-মায়াবতীর জোটের জেরে ফুলপুর এবং গোরখপুরে হারতে হয়েছে বিজেপিকে। প্রায় তিন দশক বাদে শুধু রাজস্থান থেকে পঞ্জাব, মধ্য প্রদেশ থেকে ওড়িশা, সর্বত্র একই ছবি। যে যেখানে শক্তিশালী, বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে সেই সেখানে মুখ। রাজস্থান, পঞ্জাব, মধ্য প্রদেশ, কর্ণাটক, ছত্তিশগড়, গুজরাতে বিজেপি বিরোধী প্রধান শক্তি কংগ্রেস। অন্যদিকে ওড়িশাতে বিজেডি, তামিলনাডুতে ডিএমকে, অন্ধ্রে টিডিপি, ওয়াই এস আর, তেলেঙ্গানায় টিআরএস, বিহারে আরজেডি, উত্তর প্রদেশে এসপি এবং বিএসপি, মহারাষ্ট্রে এনসিপি এবং বাংলায় টিএমসি দিল্লি বিরোধী লড়াইয়ে প্রধানতম মুখ। এটাই আজকের বাস্তবতা।
অবশ্য বাস্তবতার উল্টোদিকে অবস্থান নেওয়া সিপিআইএমের মজ্জাগত। আর বাংলা ও বাঙালির বিরোধিতা সিপিআইএমের ডিএনএ’তে। জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী না হতে দেওয়া, সরকারে যোগ না দেওয়া, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বহিষ্কার, এ সবই ছিল বাংলা ও বাঙালি বিরোধী অবস্থানের বহিঃপ্রকাশ। সাম্প্রতিক স্লোগান, বিজেপিকে হারাতে গেলে আগে তৃণমূলকে হারাতে হবে- এও বাংলা ও বাঙালি বিরোধী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। এই আত্মঘাতী লাইনের ফলে লাভবান হচ্ছে বিজেপিই।
সিপিআইএমকে পরিষ্কার করে বলতে হবে তারা বিজেপিকে ঠেকাতে চান কি চান না। যদি চান তবে বাংলায় বিজেপি বিরোধী মূল শক্তি তৃণমূলকে বৃহত্তর স্বার্থে সমর্থন করতে হবে। এ’কথা অবশ্য দলের অভ্যন্তরে উঠে গিয়েছে। ধামাচাপা দিয়ে রাখা যাচ্ছে না। প্রাক্তন এক সাংসদ প্রকাশ্যেই বলেছেন যে এই মুহূর্তের ঐতিহাসিক দায়িত্ব বিজেপিকে রোখা। আর তার জন্য যা প্রয়োজন তাই করা উচিত। কর্মী সমর্থকদের একটা বড় অংশ তাই মনে করছেন।
নিয়মানুবর্তিতার কঠিন শৃঙ্খলে প্রকাশ্যে তা না বলতে পারলেও অনেক পার্টি সদস্যই অভ্যন্তরে তা বলেছেন। সমর্থকদের অবশ্য সে সমস্যা নেই। তারা তাদের বিরক্তি প্রকাশ্যেই উগরে দিচ্ছেন। অনেকে এই দ্বিচারিতায় বিরক্ত হয়ে ইতিমধ্যেই মমতা বন্দোপাধ্যায়ের বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ের শরিক হয়েছেন। অনেকেই হওয়ার জন্য প্রস্তত হচ্ছেন। নেতৃত্বের অবশ্য তাতে হেলদোল নেই। শিক্ষা হয়নি ত্রিপুরার ফলের পরেও। নেতৃত্ব ব্যস্ত ফ্যাসিবাদ ও কতৃত্ববাদ বিশ্লেষনে। ব্যস্ত শ্রেনী সংগ্রামের স্তর নিয়ে। ব্যস্ত পাটি কংগ্রেসের ভোটাভুটি নিয়ে।
অবস্থান পরিস্কার করতে হবেই সিপিএমকে। বাংলা ও দেশের মানুষ জানতে চায় বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে সিপিএম কোনদিকে? একেজি ভবন এবং আলিমুদ্দিন স্ট্রিটকে স্পষ্ট করতে হবে, তারা ভুলের চক্রবূ্হ্যে পাক খেয়ে বাংলার আরও সর্বনাশ করবেন নাকি বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ের প্রধান মুখ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত শক্ত করবেন? পক্ষ যে নিতেই হবে। প্রকাশ্যে বলতে হবে সিপিএমকে ফ্যাসিবাদের পক্ষে না ফ্যাসিবাদের বিপক্ষে। মাঝামাঝি কোনো লাইন হয় না কমরেড। পক্ষ নিন। অবস্থান স্পষ্ট করুন। ফ্যাসিবাদ না কতৃত্ববাদ? এ বলে পাশ কাটানোর দিন শেষ। এই তাত্ত্বিকতা সিপিএমের মহাফেজখানায় দলিল হিসেবে স্থান পাবে। কিন্তু এখনও বাস্তবতা মেনে বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে মমতা বন্দোপাধ্যায় হাত শক্ত না করলে মহাফেজখানার ওই দলিলগুলো থেকে ধূলো ঝাড়বার লোকও আর পাওয়া যাবে না।