আফ্রিকার একটা ছোট্ট দেশ রাওয়ান্ডা, দু’ধরনের উপজাতির বাস মুলত। হুতুস’রা সংখ্যাগুরু এবং টুটসিরা সংখ্যালঘু। তারা একই ভাষায় কথা বলে, প্রায় একই রকম জামা-কাপড় পরে, খাওয়া-দাওয়াও প্রায় একই রকম। ১৯১৬ সালে বেলজিয়ান শাসকরা আফ্রিকার এই ছোট্ট দেশ রাওয়ান্ডাতে একটা পরিচয়পত্র চালু করে, যাতে দু’ধরনের জনজাতিকে চিহ্নিত করা যায়। আর সেখান থেকে ধীরে ধীরে শুরু হয় বিরোধ। ১৯৫৯ সালে দেশজুড়ে বেশ কিছু ছোট খাটো দাঙ্গা হয়। ১৯৬২ সালে হুতুসরা টুটসি ক্ষমতা দখল করে। তারপর তুষের আগুনের মতো ভেতরে ভেতরে চলতে থাকে এই দুই জনগোষ্ঠীর বিরোধ। তারপর ১৯৯৪ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্টকে রকেট হামলায় মেরে ফেলা হয়। সেই বিমান হানার পরপরই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে টুটসিদের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্করভাবে প্রচার চালানো হয়। তার ফলশ্রুতিতে এপ্রিল থেকে জুনে ১০০ দিনের মধ্যে ৮ লক্ষ টুটসি মানুষকে হত্যা করা হয়। সংগঠিত সরকারি সেনা এবং মিলিশিয়া অস্ত্র সহকারে মিছিল করে টুটসি জনজাতির যেখানে বসবাস, সেখানে হামলা চালায়। হত্যা করে নৃশংসভাবে টুটসিদের, কারণ সেই অঞ্চল এবং মানুষরা আগে থেকেই ওই পরিচয়পত্র দ্বারা চিহ্নিত। হুতুসরা মনে করতো, ক্ষমতায় থাকতে গেলে টুটসিদের শেষ করতে হবে। এর পিছনে আর এক রকম প্রচারও করা হয়েছিল রাওয়ান্ডার রেডিওর মাধ্যমে, টুটসিদের মারতে পারলে পুরস্কার দেওয়া হবে এবং তাদের জমি-জায়গার মালিক হবে হুতুসরা।
এবার আসা যাক আমাদের দেশের প্রসঙ্গে। ধীরে ধীরে একটা সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গুজরাত, মুজফফরনগর, ভাগলপুর, কাসগঞ্জ, বসিরহাট, কালিয়াচক, এরকম ছোট ছোট দাঙ্গার খবর আমরা ইতিমধ্যেই শুনে নিয়েছি। যদিও এর মধ্যে গুজরাত ছিল সবচেয়ে বড়, যাতে প্রায় ২ হাজার মুসলমান মানুষকে চিহ্নিত করে মারা হয়। আফরাজুল,জুনেইদ, পেহেলু খান বা উমর খানদের মতো ঘটনা, মানে চিহ্নিত করে মারার ঘটনাও আমাদের দেশ দেখে ফেলেছে। এর সাথে সাথেই চলেছে আধারের মাধ্যমে মানুষকে চিহ্নিতকরণের কাজ।
আপনি কোথায় থাকেন, অঞ্চলটা মিশ্র কি না? বয়স কত? ফেসবুক বা ট্যুইটারে কী পোস্ট করেন? সেটা কি সরকার বিরোধী? খেয়াল করে দেখুন, অর্থনীতি মোটামুটি তলানিতে, চাকরি নেই। লোকের ক্রয় ক্ষমতা কমে গেছে বিমুদ্রাকরণ এবং জিএসটির জন্য। এখন একটাই কাজ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগাও, তারপর গণহত্যা কর। আধার এখন প্রায় সব কিছুর সাথে যুক্ত করার কাজ চলছে, এরপর শুধু বাকি আছে ভোটার কার্ডের সাথে আধার যুক্ত করার কাজ। আচ্ছা এটা করলে কী হতে পারে? আমি, আপনি কোনও দিনই আর এই সাম্প্রদায়িক শক্তিকে সরাতে পারব না। কারণ, আমার, আপনার সমস্ত তথ্য আজ ওদের হাতের মুঠোতে। আমি, আপনি এখন শুধুমাত্র একটা সংখ্যা, আমাকে বা আপনাকে মুছে দেওয়া আজ ওদের এক ইশারাতেই হয়ে যাবে। এরপর শুরু হবে চিহ্নিত করে মারার কাজ। সাবির থাকে মোমিনপুরে, রিয়াজ থাকে খিদিরপুরে, এটা তো ওদের জানা হয়ে গেছে। কিংবা অমিত, মৃণালরা যে কমিউনিস্ট সেটা তো তাঁর আধার এবং সোশ্যাল মিডিয়ার চলাফেরা দেখেই বোঝা সম্ভব। যাঁরা ভাবছেন, আধার দেশের একমাত্র পরিচয়পত্র মাত্র, তাঁরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন।
যাঁরা সোশ্যাল মিডিয়া নিয়মিত ব্যবহার করেন তাঁরা নিশ্চয় খেয়াল করেছেন, চারিদিকে ‘আমিও চৌকিদার’ বলার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। কেন এটা তৈরি হয়েছে? এর পাশাপাশি চলছে প্রচার, ‘আমার পরিবার, বিজেপি পরিবার’। যেন এর বাইরে যাঁরা থাকবেন, তাঁরাই দেশদ্রোহী। এই দেশদ্রোহী চিহ্নিত করার কাজটা চলছেই। ঠিক যেমন নোটবন্দির সময়ে হয়েছিল, কেউ কেউ ভেবেছিলেন, তাঁর পাশের বাড়ির মানুষটির খুব অসুবিধা হল, ওর প্রচুর কালো টাকা। অন্যজনও একই রকমভাবে ভাবলেন। মাঝখান থেকে জিতে গেল কে? আসলে একজনকে অন্যজনের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিয়ে, হিন্দুকে মুসলমানের বিপক্ষে, একজন দলিত মানুষের বিপক্ষে একজন উচ্চ বর্ণের সাধারণ মানুষকে লড়িয়ে দিতে পারলেই কিছু মানুষ সফল হয়। আসল যে লড়াই রুটি, রুজি, বাসস্থানের, লড়াইটাকে তাহলে পিছনে ঠেলে দেওয়া যায়। জল, জমি, জঙ্গল যাঁরা উন্নয়নের নাম করে লুটে নিচ্ছেন, তাঁদের গায়ে যাতে আঁচড়টি না লাগে তাই এই ব্যবস্থা। যদি খেয়াল করা যায়, এই নোটবন্দি বা আধারের কারণে অসুবিধা কিন্তু সাধারণ মানুষরাই ভোগ করছেন। দেশের ১ শতাংশ মানুষের হাতে আজ ৭৩ শতাংশ সম্পত্তি, তাঁরাই নিয়ন্ত্রণ করছেন অর্থনীতি, রাজনীতি সব। তাঁরাই আরও সম্পত্তি দখল করতে চাইছেন।
সেদিনটা ছিল ৬ ই এপ্রিল, ১৯৯৪ সাল। আজ থেকে ২৫ বছর আগে রাওয়ান্ডার গণহত্যা আজও পৃথিবীর মানুষ ভুলতে পারেনি। আজও পৃথিবীর প্রথম সারির সংবাদপত্রে এই গণহত্যার কথা বড় করে লেখা হয়। লেখা হয়, এই গণহত্যাকে যদি আমরা বুঝতে না পারি তাহলে ভবিষ্যতে এই ধরনের সংগঠিত গণহত্যা আবারও হবে। ইতিহাসকে ফিরে দেখতে হয় ভবিষ্যতকে বোঝার জন্যই। ২৭ বছর আগে ধ্বংস হওয়া বাবরি মসজিদ বা ২০০২ সালের গুজরাত গণহত্যা বা ২৫ বছর আগের সুদূর আফ্রিকার ছোট্ট দেশের গণহত্যা কোথায় যেন মিলেমিশে যায়।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Comments are closed.