করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউন ও দূরত্ব বজায় রাখার কারণে সংকটের মুখে শান্তিপুর পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকার তাঁতি সম্প্রদায়। এই পরিস্থিতিতে চাহিদা না থাকায় শাড়ি উৎপাদন খুবই কম পরিমাণে হচ্ছে। তার সঙ্গে শাড়ির দাম কমে যাওয়ায় তাঁতিরা আগে যে মজুরি পেতেন, এখন তার অর্ধেকেরও কম পাচ্ছেন।
বাংলার তাঁত শিল্পের দুটি পীঠস্থানের মধ্যে একটি হলো নদিয়ার শান্তিপুর। মুঘল আমল থেকেই শান্তিপুরের উৎকৃষ্ট তাঁতের শাড়ি ভারতজুড়ে খ্যাতি লাভ করেছে। এখানকার তাঁত শিল্প সম্পর্কে দীনবন্ধু মিত্র লিখেছিলেন- “শান্তিপুরের ডুরে শাড়ী সরমের অরি/ নীলাম্বরী, উলঙ্গিনী, সর্বাঙ্গ সুন্দরী…”। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ও এখানকার তাঁত শিল্প দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও এই শান্তিপুরের তাঁত নিয়ে আগ্রহী ছিল। কিন্তু বর্তমানে এই শান্তিপুরী তাঁত শিল্পের অবস্থা ক্রমশ নিম্নগামী। বাংলার ইতিহাসে তাঁত শিল্পের ও তাঁতিদের বিপর্যয়ের গল্প নতুন নয়। তবে করোনা পরিস্থিতি তাঁদের জীবনে এক অন্যরকম বিপর্যয় নিয়ে এসেছে, যার জন্য তাঁরা প্রস্তুত ছিলেন না একেবারেই।
করোনা পরিস্থিতির আগে একটি শাড়ির মজুরি হিসেবে শিল্পীরা ৩০০ টাকা পেতেন। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে তাঁরা কখনও ১০০ টাকা, কখনও ১২০ টাকা, আবার কখনও ১৫০ টাকা মজুরি পাচ্ছেন। কম টাকাতেই তাঁরা কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। যা দিয়ে সংসার চালানো তাঁদের পক্ষে সম্ভবপর হচ্ছে না। দীর্ঘ ৩৫-৪০ বছর এই পেশার সঙ্গে যুক্ত থেকে এমন হাহাকার পরিস্থিতির মুখোমুখি এই প্রথমবার শিল্পীরা। প্রত্যেক বছর দুর্গা পুজোর আগের সময়টা তাঁতিদের কাছে প্রচণ্ড ব্যস্ততার। এই সময়ে উৎপাদন সব থেকে বেশি হয়। তেমনই শাড়ির দামটাও একটু বেশি থাকে। কিন্তু এবছর পুজোর আগে উৎপাদন অন্যান্যবারের তুলনায় অনেক কম।
সাধারণত মহাজনরা তাঁতিদের কাঁচামাল সরবরাহ করেন এবং তাঁরা তৈরি শাড়ি হাটে বিক্রির জন্য নিয়ে যান। অনেক ব্যবসায়ীও তাঁদের থেকে শাড়ি কিনে হাটে বিক্রি করতে যান। কিন্তু এবার ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় বেশি পরিমাণে শাড়ি বয়ে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে উঠেছে তাঁদের পক্ষে। যদিও স্বল্প পরিমাণ শাড়ি বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, সেগুলোও কম টাকায় বেচতে বাধ্য হচ্ছেন। কখনও কখনও বিক্রিও কম হচ্ছে। আবার কখনও হাট প্রায় ফাঁকা থেকে যাচ্ছে। সমস্যায় পড়তে হচ্ছে তাঁতিদের।
এমন পরিস্থিতি তাঁদের আগে কখনও পড়তে হয়নি বলেই জানাচ্ছেন শান্তিপুরের তাঁতিরা। দুর্গা পুজোর পর শাড়ির চাহিদা একটু কমলে তাঁদের মজুরিও ২০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত কমে যায়। কিন্তু বর্তমানের মতো এমন মজুরি তাঁরা দীর্ঘ ৪০ বছরেও পাননি।
পশ্চিমবঙ্গ ‘ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প দফতরের অন্তর্গত এই তাঁত শিল্প। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে শিল্পীদের স্বার্থে অনেক রকম পদক্ষেপ নিলেও, করোনা পরিস্থিতিতে তাঁতি সম্প্রদায়ের জন্য এখনও বিশেষ কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। সুদিনের আশায় বুক বাঁধছেন বিপর্যস্ত তাঁতিরা।
Comments are closed.