ভারতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ মধ্য গগনে। পূর্ব লাদাখ সীমান্তে যুদ্ধের চোখরাঙানি কিংবা অর্থনীতির বেনজির পতন। আজকের ভারতের মূল ৩ টি ইস্যু কি এইগুলো? মাথা নেড়ে সায় দিচ্ছেন যাঁরা, তাঁরা কি জানেন, এই ইস্যু-ত্রয় আদৌ ভারতের টিভি দর্শকদের দুনিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ নয়! সুশান্ত সিংহ রাজপুত এবং রিয়া চক্রবর্তীকে নিয়েই যত উৎসাহ, কৌতূহল! সাম্প্রতিক অতীতে কোন নিউজ চ্যানেল কোন ইস্যু নিয়ে কত সময় খরচ করেছে তার একটি তুলনামূলক পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে ইংরেজি পোর্টাল newslaundry.com। তাতে দেখা যাচ্ছে, ভারতের টিভি নিউজের জগতে কোভিড-চিন বা আর্থিক মন্দা নয়, সুশান্ত-রিয়া চক্রবর্তীই মূল ইস্যু। আর এই বদলে যাওয়া প্রায়োরিটির নিউজ চ্যানেলের ইঁদুর দৌড়ে আজ তককে হারিয়ে এক নম্বরে পৌঁছে গিয়েছে অর্ণব গোস্বামীর রিপাবলিক ভারত হিন্দি নিউজ চ্যানেল।
newslaundry.com র প্রতিবেদন জানাচ্ছে, সুশান্ত সিংহ রাজপুতের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পরপরই নিউজ চ্যানেলগুলোতে হতাশার জেরে আত্মহত্যার তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা চলছিল। তাতে যেমন সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের মতামত নেওয়া হচ্ছিল, তেমনই মানসিক স্বাস্থ্য দেখভালের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু সপ্তাহ শেষে দেখা যায় এই সামাজিক বিষয়ে আলোচনার টিআরপি নেই। তারপরই রাতারাতি খেলা বদলে যায়। নিউজ চ্যানেলে উঠে আসতে থাকে হত্যার একের পর এক নিত্য নতুন তত্ত্ব। রিয়া চক্রবর্তীর গ্রেফতারি তাতে ঘি ঢালে। শুরু হয় রিয়া চক্রবর্তীর চরিত্র হনন। তাতে একদিকে যেমন ব্ল্যাক ম্যাজিক নিয়ে আসা হয় তেমনই রিয়া চক্রবর্তীর বাঙালির শিকড় ধরেও শুরু হয় যথেচ্ছ টানাটানি। আর যত এইসব চলতে থাকে, ততই বাড়তে থাকে চ্যানেলের টিআরপি।
প্রতিবেদনে একটি গ্রাফ তুলে ধরে দাবি করা হয়েছে, ৮ সেপ্টেম্বর রিয়া চক্রবর্তীর গ্রেফতারির আগে বেশির হিন্দি ও ইংরেজি নিউজ চ্যানেলই ৭০ শতাংশ এয়ার টাইম খরচ করেছে সুশান্ত সিংহ রাজপুতের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে আলোচনায়। রিয়া চক্রবর্তীর গ্রেফতারির পর চ্যানেলগুলোতে কেবল সুশান্ত মৃত্যু রহস্যই ছেয়ে ছিল। সেখানে প্রথমে আসে ড্রাগ কানেকশন, তারপর একে একে আসতে থাকে ব্ল্যাক ম্যাজিক, রিয়ার বাঙালি শিকড়। বার্কের টিআরপি রেটিং দেখে বোঝা যায়, কোভিড-চিন-মন্দা নয় বরং রিয়া-সুশান্ত নিয়েই মানুষের বেশি কৌতূহল। যখন ভারতে রোজ এক হাজারেরও বেশি মানুষের করোনায় মৃত্যু হচ্ছে, যখন সীমান্তে চিনের যুদ্ধ দামামা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে পৌঁছচ্ছে, সর্বোপরি দেশের অর্থনীতি যখন কোমর ভেঙে পড়েছে, তখন সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে নিউজ চ্যানেলগুলোর সুশান্ত-রিয়া রহস্য নিয়ে মেতে থাকা কীসের ইঙ্গিত?
নিউজলন্ড্রির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পয়লা মে থেকে ১০ সেপ্টেম্বর সময়কালকে বেছে নিয়ে দেশের বড় বড় নিউজ হাউসগুলোর পর্যায়ক্রমিক তত্ত্বতালাশ করা হয়েছে। এই পদ্ধতিতে প্রতিবেদনটির লেখকরা সুশান্ত সিংহ রাজপুত এবং রিয়া চক্রবর্তীর নামাঙ্কিত সবকটি ইউটিউব ভিডিওর দৈর্ঘ পরিমাপ করেছেন। এতে ইংরেজি যেমন আছে, তেমনই আছে হিন্দিও।
ওই দুই নামের মোট যে ক’টি ভিডিও আপলোড হয়েছে তার বহরকে এক সপ্তাহে আপলোড করা এই সংক্রান্ত ভিডিও দিয়ে ভাগ করলে পাওয়া যায় একটি নির্দিষ্ট ইস্যুতে একটি নিউজ চ্যানেল কত সময় কাটিয়েছে তার হিসেব।
সেই হিসেব বলছে, ১৪ জুন, যেদিন সুশান্তের অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবর পাওয়া গেল কিংবা ২৫ জুন, যেদিন তাঁর পরিবার রিয়া চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করেন, সেই দিনগুলোতে এই ইস্যু নিয়েই থাকবে চ্যানেলগুলো, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু হিসেবে দেখা যাচ্ছে অর্ণব গোস্বামীর রিপাবলিক টিভি, নভিকা কুমার-রাহুল শিবশঙ্করের টাইমস নাও এবং অঞ্জনা ওম কাশ্যপের আজ তক চ্যানেল অগাস্ট মাসজুড়ে ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ সময় অনুষ্ঠান সম্প্রচার করেছে এই ইস্যুতেই। এবিপি নিউজ ৪০-৫০ শতাংশ সময় ছিল সুশান্ত-রিয়া ইস্যু নিয়ে। বিজেপি সাংসদ সুভাষ চন্দ্রের জি টিভি অগাস্টে গড়ে ২০ শতাংশ সময় এই ইস্যুর জন্য বরাদ্দ করলেও মাসের শেষ সপ্তাহে তা বেড়ে হয়ে যায় ৫০ শতাংশ। এক্ষেত্রে ২৮ অগাস্ট এনডিটিভিতে রিয়া চক্রবর্তীর ইন্টারভিউয়ের কাটাছেঁড়া করতে বেশিরভাগ সময় গিয়েছে জি নিউজের।
সম্পূর্ণ বিপরীত ছবি অন্য ইস্যুর ক্ষেত্রে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একমাত্র এনডিটিভি বাদে বাকি সমস্ত চ্যানেলই জিডিপি, অর্থনীতি কিংবা কোটি মানুষের চাকরি হারানোকে খবর বলেই মনে করেনি। পরিসংখ্যান বলছে, এই চ্যানেলগুলো অর্থনীতি-ছাঁটাই বা জিডিপি নিয়ে ব্যয় করেছে ২ শতাংশেরও কম সময়। এক্ষেত্রে এনডিটিভি সামান্য হলেও ব্যতিক্রম।
২ সেপ্টেম্বর জানা যায়, অর্থবর্ষের প্রথম ৩ মাসে জিডিপি সঙ্কুচিত হয়েছে প্রায় ২৪ শতাংশ। যা সবদিক থেকেই নজিরবিহীন। অথচ রিপাবলিক টিভি, টাইমস নাও এবং আজ তক নিউজ চ্যানেল ৫ শতাংশেরও কম সময় ব্যয় করেছে অর্থনীতির বেহাল অবস্থা নিয়ে। তারপর আবার তারা ফিরে গিয়েছে রাজপুতের অস্বাভাবিক মৃত্যু এবং তার পিছনে রিয়া চক্রবর্তীর কল্পিত ভূমিকার কাটাছেঁড়ায়। এক্ষেত্রে মন্দের ভালো এনডিটিভি। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তারা প্রায় ১২ শতাংশ সময় ব্যয় করেছে জিডিপি নিয়ে আলোচনা এবং খবর সম্প্রচারে।
Comments are closed.