দৃষ্টিহীন সায়ন্তনকে ফিরিয়েছিল শহরের ২৯ স্কুল! ভর্তি নেয় পাঠভবন, আজ তিনিই অনলাইনে ক্লাস নেন, চালান রেডিও চ্যানেল
কলকাতার ২৯ টি নামীদামি স্কুল ভর্তি নেয়নি তাঁকে। কারণ, তিনি দৃষ্টিহীন। তিনিই অতিমারি পরিস্থিতিতে অনলাইনে আজ ক্লাস নিচ্ছেন ছাত্রছাত্রীদের। পেশা ও প্যাশনকে ব্যালান্স করে কলকাতার দ্বিতীয় দৃষ্টিহীন ব্যক্তি হিসেবে তৈরি করে ফেলেছেন অনলাইন রেডিও প্ল্যাটফর্ম ‘রেডিও লাউঞ্জ’। বাংলা ইন্ডিপেনডেন্ট মিউজিককে কলকাতা থেকে ক্যালিফোর্নিয়া, লাহোর থেকে লন্ডন ছড়িয়ে দেওয়া, নতুন ট্যালেন্টদের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দেওয়ার স্বপ্নে বিভোর কসবার সায়ন্তন ব্যানার্জি।
তিনি কাজ করেন ছাত্র গড়ার। কিন্তু শুধু দৃষ্টিহীন হওয়ার জন্যই ছাত্রাবস্থায় ‘আধুনিক’ কলকাতার বহু আঘাত ও অবহেলা সয়েছেন সায়ন্তন। সেই অবহেলা এখনও আছে, কিন্তু তিনি গেয়ে চলেছেন জীবনের গান।
১৯৯২ সালে ৭ জুলাই কসবা রুবিপার্কের মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম সায়ন্তনের। কিন্তু জন্মের ছয় মাসের মধ্যে শারীরিক সমস্যা এমন হয় যে, ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছিলেন বাচ্চাটিকে বাঁচানো সম্ভব নয়। সব উপার্জন, সঞ্চয় ঢেলে দিয়ে ছেলেকে ভালো করার আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করেন সায়ন্তনের বাবা-মা। বেসরকারি কোম্পানির স্বল্প বেতনের কর্মী হয়েও ছেলের চিকিৎসার জন্য কলকাতার প্রচুর ডাক্তার-হাসপাতাল করেন তিনি। এমনকী বেসরকারি হাসপাতালে প্রতিদিন ৩ হাজার টাকা বেড ভাড়া দিয়ে ছেলের চিকিৎসা করেন।
নয় মাস বয়সে শারীরিক অবস্থা কিছুটা ভালো হলেও সারা জীবনের জন্য দৃষ্টিশক্তি হারান সায়ন্তন। বহু চিকিৎসা, পরিবারের সর্বাত্মক চেষ্টায় জীবন বাঁচে শিশুটির, কিন্তু তারপর তার জন্য অপেক্ষা করছিল অনন্ত সংগ্রাম, হোঁচট, বাধা ও অবহেলা। সেসব কাটিয়ে এগিয়ে চলতে চলতেই ছেলেটি আজ শিক্ষক এবং বাচিকশিল্পী।
ততদিনে স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়েছে সায়ন্তনের। বাড়ির পাশের স্কুলে ছেলেকে ভর্তি করাতে নিয়ে যান বাবা। কিন্তু স্কুল জানাল, দৃষ্টিহীনদের পড়ানোর কোনও ব্যবস্থা নেই। অগত্যা টালিগঞ্জ লাইটহাউস ফর দ্য ব্লাইন্ড স্কুলে ভর্তি। সেখানে ব্রেল পদ্ধতি কিছুটা আয়ত্ত করেন ছোট্ট সায়ন্তন। তারপর সাত বছর বয়সে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমিতে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হন তিনি। শুরু হল পড়াশোনা। শুরু হল নিজের কাজ নিজে করে নেওয়ার পাঠ। তাঁর জীবনবোধ তৈরি করার পিছনে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের অবদান অনস্বীকার্য বলে জানান সায়ন্তন। সেখানে পড়াশোনার পাশাপাশি বিতর্ক, ক্যুইজ, নানা অনুষ্ঠানে সক্রিয় অংশ নিতে শুরু করলেন সায়ন্তন। এভাবেই ২০১১ সালে বেশ ভালো নম্বর পেয়েই মাধ্যমিক পাশ করলেন তিনি। অনেক স্বপ্ন নিয়ে শহর কলকাতার কয়েকটি বিখ্যাত স্কুলে ভর্তির আবেদন করেন সায়ন্তন। কিন্তু বড়ো বড়ো স্কুলগুলোতেও বাধা সৃষ্টি করল সায়ন্তনের দৃষ্টিহীনতা। জানানো হল, তাঁকে পড়ানোর মতো সঠিক পরিকাঠামো নেই! আবার অনেক স্কুলে ভর্তি হতে গিয়ে জোটে তাচ্ছিল্য ও অবহেলা। পরীক্ষায় নম্বর ভালো হওয়া সত্ত্বেও কলকাতার বুকে ২৯ টি স্কুল তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু সায়ন্তন বরাবরই হাল না ছাড়ার দলে। এরপর একটি স্কুল তাঁকে শুধু ভর্তিই নিল না, জানাল উষ্ণ অভ্যর্থনাও। স্কুলের নাম পাঠভবন। শিক্ষকদের স্নেহের পরশ পেতে শুরু করলেন তিনি। একটু সময় লাগল বটে, তবে সহপাঠীরাও আস্তে আস্তে ভালো বন্ধু হয়ে উঠতে লাগল তাঁর। তারপরেও বাধা বহু। যেমন ২০১৩ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার আগের দিন রাত পর্যন্তও সায়ন্তন জানতেন না আদৌ পরীক্ষা দিতে পারবেন কিনা। কারণ সেই দৃষ্টিহীনতা। শিক্ষা দফতরের কাছে রাইটারের পারমিশন নিতে গেলে তারা প্রথমে তা দিতে অস্বীকার করে। পাঠভবনে এরকম এক ছাত্র যে পড়াশোনা করে সেটাই তাদের অজানা। বিকাশ ভবনে গিয়ে সায়ন্তনকে প্রমাণ করতে হয় তিনি সত্যিই দৃষ্টিহীন। স্কুল, পরিবার সবার সহযোগিতায় পরীক্ষার আগের দিন সন্ধ্যায় সায়ন্তন জানতে পারেন, তিনি পরীক্ষা দিতে পারবেন।
তারপরেও পরিচিতি মহল বা রাস্তাঘাটে বেরোলে অবহেলা, অকারণ করুণা ঠিকই এসেছে। পরিচিতরা বলাবলি করেছে, ‘এত সবের পরেও কি প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে?’ সায়ন্তনের কথায়, একদিন মায়ের সঙ্গে বেরিয়েছিলাম। একজন ভালোই বুঝতে পারছিলেন, আমি চোখে দেখতে পাই না। তবুও মাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ও কি একেবারেই দেখতে পায় না?’ একজন মায়ের কাছে এটা শোনা যে কতখানি কষ্টের, সেই সূক্ষ্ম অনুভূতিটা বোধহয় কম মানুষের মধ্যেই আছে। আবার এক আত্মীয়ের বিয়েবাড়িতে সবার নিমন্ত্রণ এলেও বাদ পড়েন কেবল সায়ন্তন। বিয়েবাড়িতে দৃষ্টিহীন মানুষ থাকলে নাকি অকল্যাণ হয়, এমনই ছিল সেই আত্মীয়ের যুক্তি। গত ২৭ বছরে এমন নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এবং মুহূর্তের সাক্ষী হয়েছেন সায়ন্তন। সাময়িক মন খারাপ হয়েছে। কিন্তু বরাবরই তাচ্ছিল্য, প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে তিনি এগিয়ে যাওয়ার দলে। বরং মন খারাপের দিনে সঙ্গী করে নিয়েছিলেন রেডিওকে। দুর্গাপুজোয় প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে যখন ভিড় উপচে পড়ে, সায়ন্তন তখন প্রতিমা দর্শন করেন রেডিওর চোখ দিয়ে। বিভিন্ন এফএম চ্যানেলের বেশ কিছু প্রোগ্রাম তিনি নিয়ম করে শুনতেন। রেডিও মির্চির আরজে দীপ সায়ন্তনের সবচেয়ে পছন্দের। যত দিন গড়িয়েছে সায়ন্তনের সঙ্গে রেডিওর সম্পর্ক তত গাঢ় হয়েছে। এর মধ্যে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। যেখানে কমিউনিটি রেডিও জেইউ-তে তাঁর আরজে হিসেবে হাতেখড়ি। অনেকদিন ধরে ভাবছিলেন এই এগিয়ে যাওয়া সময়ে রেডিওর ডিজিটাইজেশনের শরিক হবেন। এরই মধ্যে সাহেব নামে তাঁর এক বন্ধু অনলাইন রেডিও প্ল্যাটফর্ম খুলে ফেলেন। ঘটনাচক্রে তিনিও দৃষ্টিহীন। কিছুটা তাঁর উদ্দীপনা আর নিজের সুপ্ত ইচ্ছেকে বাস্তব রূপ দিতে ৮ মে আত্মপ্রকাশ করে সায়ন্তনের অনলাইন রেডিও প্ল্যাটফর্ম। নাম Radio Lounge (https://play.google.com/store/apps/details?id=net.bongonet.sayantan)। বাংলা ইন্ডিপেনডেন্ট মিউজিককে আলাদা করে জায়গা করে দিতেই তাঁর এই উদ্যোগ। সায়ন্তনের কথায়, কলকাতায় প্রচুর ভালো ভালো ইন্ডিপেনডেন্ট মিউজিকের কাজ হচ্ছে। কিন্তু সেভাবে তাঁরা প্রচার পাচ্ছেন না। আর এই ডিজিটাল যুগে রেডিও কেন শুধু ৯০- ১০০ কিমি জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকবে? কেন বিদেশ বিভুঁইয়ে বসে কোনও বাঙালি শুনতে ও জানতে পারবেন না, বাংলায় সঙ্গীত নিয়ে নতুন কী কী কাজ হচ্ছে? খুব তাড়াতাড়ি রেডিও লাউঞ্জে আসছে ‘পুজোর বৈঠক’ নামে একটি অনুষ্ঠান। যেখানে কলকাতার নতুন চারজন ট্যালেন্ট নিয়ে কাজ করতে চলেছেন সায়ন্তনরা।
পেশা ও প্যাশনের একটি ব্যালান্স তৈরি করে চলতে ভালোবাসেন সায়ন্তন। তাই বিক্রমগড়ের একটি প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতার পাশাপাশি নিজের শিল্পসত্তাকে টিকিয়ে রাখতে কাজ করে চলেছেন সায়ন্তন। ছাত্র সায়ন্তনের দৃষ্টিহীনতার ২৯ টি স্কুল তাঁকে ভর্তি নিতে অস্বীকার করেছিল। এখন পড়ুয়াদের মধ্যে দারুণ জনপ্রিয় শিক্ষক সায়ন্তন গুগল মিটে ক্লাস নিচ্ছেন। তাদের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলছেন। অনলাইন ক্লাস করতে অপরাগ পড়ুয়াদেরও যাতে শেখার খামতি না থাকে তার জন্য সচেষ্ট সায়ন্তন ব্যানার্জিরা।
Comments are closed.