কেউ বলতেই পারেন কাকতালীয়। কিন্তু ভেলোরের অম্বুর ইয়াপার কাহিনির পরতে পরতে এক নাছোড়বান্দা, কঠোর পরিশ্রমী মানুষের উত্তরণের বৃত্তান্ত। এক সাধারণ ডেলিভারি বয়ের মিলিওনিয়ার হওয়ার রোমহর্ষক কিস্যা। ই-কমার্স সংস্থা ফ্লিপকার্টের চার অঙ্কের পারিশ্রমিক পাওয়া এক কর্মী থেকে কীভাবে আজ বিলিওনেয়ার অম্বুর ইয়াপা?
তামিলনাড়ুর ভেলোর জেলার এক নিম্নবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা অম্বুর ইয়াপার। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে যাওয়া হয়নি তাঁর। বাড়ি থেকে ১২৫ কিমি দূরে হসুরে একটা ডিপ্লোমা কোর্স করতে গিয়েছিলেন। সেই শংসাপত্র সম্বল করে বিখ্যাত গাড়ি নির্মাণ কোম্পানি অশোক লেল্যান্ডে শিক্ষানবিশ হিসেবে কর্মজীবন শুরু অম্বুরের। সেখান থেকে ফের একটু ভালো কাজ আর সামান্য বেশি বেতনের জন্য ইয়াপা পাড়ি দিলেন বেঙ্গালুরু। ফার্স্ট ফ্লাইট কুরিয়ার্সের ডেলিভারি বয়ের কাজ পেলেন। কুরিয়ার সার্ভিসের কাজ করতে করতে অম্বুর ইয়াপা খুঁজে পান তিনি আসলে কী করতে চান, তার সন্ধান।
লজিস্টিক ক্ষেত্রে সমস্ত কাজকর্ম দেখতে ও বুঝতে শুরু করলেন তিনি। সেই পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা এত তীব্র যে মাত্র চার বছরের মধ্যে দক্ষিণ বেঙ্গালুরুর সেই লজিস্টিক ক্ষেত্রের ম্যানেজারের পদে অম্বুর ইয়াপা। তাঁর কাজ হল, সংস্থায় আসা সমস্ত ই-মেলের তদারকি করা।
যেখান থেকে আম্বুর শুরু করেছিলেন মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু সিঁড়ি ভাঙা থামাননি অম্বুর। এই সময়ে নিজের স্কিল বাড়ানোর কাজে মন দেন। তিন মাসের একটা ডিপ্লোমা কোর্স করার সিদ্ধান্ত নেন। তার জন্য চাকরি থেকে কিছুদিন ছুটিও নিলেন। কিন্তু কোর্স শেষ করে অফিসে গিয়ে জোর ধাক্কা। সংস্থায় তাঁর শূন্যস্থান পূরণ হয়ে গিয়েছে ততদিনে। কোথায় চাকরি খুঁজবেন এবার! অনেক চেষ্টায় একটা কাজ জুটল, ফ্লিপকার্টের ডেলিভারি বয়ের। কিন্তু সেই ফ্লিপকার্ট এখনকার মতো সম্পদ আর বহরে এতটা বিখ্যাত নয়। ২০০৭ সালে বইয়ের ডেলিভারি দিতে শুরু করা নেহাতই অচেনা একটা ই-কমার্স সংস্থা তখন ফ্লিপকার্ট। সংস্থার তৎকালীন প্রধান আইআইটি দিল্লির দুই প্রাক্তনী সচিন বনশল ও বেনি বনশল। দু’জনেই আগে মার্কিনি ই-কমার্স সংস্থা অ্যামাজনে কাজ করেছেন। তাঁদের সঙ্গে দেখা করলেন অন্বুর। বই ডেলিভারি দেওয়ার সমস্যায় তখন ভুক্তভোগী দুই মালিককে সমাধান বাতলে দিয়ে সংস্থার প্রথম ডেলিভারি বয়ের চাকরি জোটালেন অম্বুর। মাসিক বেতন মাত্র ৮ হাজার টাকা। সে সব দিনের কথা মনে করে সচিন বনশল বলেন, ‘আমরা বেশি কিছু চাইনি। এমন একজনকে চেয়েছিলাম যিনি কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতো ইংরেজি বলতে পারবেন আর কম্পিউটারে প্রাথমিক জ্ঞানটুকু থাকবে। আর অম্বুর এই চাকরির প্রথম এক বছরে কোনও নিয়োগপত্র পাননি। পাবেনই বা কী করে? ফ্লিপকার্টের তখন কোনও এইচআর-ই নেই যে!
প্রথম প্রথম কাজ করতে গিয়ে ভীষণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতেন। তার উপর প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১২ জন বই প্রকাশকের সঙ্গে দেখা করা, প্রায় ১০০ টি বই ডেলিভারি দেওয়ার কাজ। যাকে বলে হাড়ভাঙা খাটনি। কিন্তু একেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে নেন অম্বুর ইয়াপা।
ক্রেতাদের সঙ্গে তাঁর ভীষণ ভালো ব্যবহার, সংস্থার কোনও সমস্যা নিরসনে অম্বুরের একান্ত চেষ্টা তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করল ফ্লিপকার্টে। আস্তে আস্তে বহর বাড়ল সংস্থার। অন্যান্য ডেলিভারি বয় তাঁদের সমস্যার কথা অন্বুরকে জানালে তার চটজলদি সমাধানে উদ্যোগী হতেন তিনি। কেউ যদি জানাতেন, অমুক একটা বই ক্রেতারা খুঁজছেন, কিন্তু স্টকে নেই। সঙ্গে সঙ্গে অন্য বিক্রেতার কাছ থেকে সেই বই জোগাড় করে সেটি ডেলিভারি না দেওয়া পর্যন্ত শান্তি নেই অম্বুর ইয়াপার। কাজে এতটাই তিনি জড়িয়ে পড়েন যে কোনও ক্রেতা কিছু তথ্য জানতে চাইলে তার জন্য আর কম্পিউটার খুলে দেখতে হত না অম্বুরকে। সব কিছু ছিল তাঁর মুখস্থ। সংস্থার এমন অবিচ্ছেদ্য হয়ে পড়লেন যে ফ্লিপকার্টের কাস্টমার কেয়ারের প্রথম দিকের নম্বরটি ছিল আসলে অম্বুরের ব্যক্তিগত ফোন নম্বর। আস্তে আস্তে সংস্থার অংশশীদারিত্ব পেলেন অম্বুর। অনেক সিদ্ধান্তই এবার স্বাধীনভাবে নিতে পারলেন। বনশলরা এমন বিশ্বস্ত ও করিৎকর্মা লোক পেয়ে দারুণ খুশি। ফ্লিপকার্টের শ্রীবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অম্বুরেরও প্রতিপত্তি বাড়তে থাকল। একটা সময় মাত্র ১২ মাসের ব্যবধানে অম্বুরের পারিশ্রমিক বেড়ে গেল ১০ গুণ! এর মধ্যে ২০০৯ এবং ২০১৩ সাল, এই দু’বার মাত্র ব্যক্তিগত অসুবিধার জন্য তাঁর শেয়ার বিক্রি করেছিলেন অম্বুর। এখন দেশের একজন সফল ব্যবসায়ী এবং কোটিপতি হিসেবে নিজেকে প্রতিষঠিত করে ফেলেছেন অম্বুর ইয়াপা। বিনি বনশলের কথায়, ফ্লিপকার্টে এমন কয়েকজন আছেন, যাঁদের জন্য সংস্থার বিপুল শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে আগে যে নামটা আসে তিনি হলেন অম্বুর ইয়াপা। অম্বুর আরও একবার প্রমাণ করলেন, জীবনে সফল হতে গেলে কঠোর পরিশ্রম আর নিষ্ঠা কতটা আবশ্যক।
Comments are closed.