বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দ্বিতীয়বার ভারতের মসনদে আসীন নরেন্দ্র মোদী। মোদী ঝড়ের কাছে খড়কুটোর মতো উড়ে গিয়েছে সারা দেশে বিরোধীদের যাবতীয় প্রতিরোধ। জিতে উঠে যদিও মোদী বলেছেন, এই জয় ভারতের সব নাগরিকের, কিন্তু তাতে আশ্বস্ত হওয়ার কোনও কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না গত পাঁচ বছর ধরে লাগাতার কেন্দ্র বিরোধী আন্দোলনে পথে নামা সেই মানুষগুলো। রোহিত ভেমুলা থেকে কৃষক দুর্দশা, একটি ইস্যুরও নিষ্পত্তি হয়নি এখনও। যদিও এই আন্দোলনগুলোর কাণ্ডারীদের কার্যত ধুয়েমুছে সাফ করে দিয়েছে প্রবল মোদী-ঝড়।
সংবাদমাধ্যমের নজরে ছিল বিহারের বেগুসরাই কেন্দ্র। সেখানে সিপিআই প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন জেএনইউ ছাত্র সংসদের প্রাক্তন সভাপতি কানহাইয়া কুমার। তাঁকে বছর তিনেক আগে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেফতার করে দিল্লি পুলিশ। ওই ঘটনার পর থেকেই বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদীর বিরোধিতায় অন্যতম মুখ কানহাইয়া। শাবানা আজমি, জাভেদ আখতার, প্রকাশ রাজ, স্বরা ভাস্করের মতো ব্যক্তিত্বরা তাঁর হয়ে প্রচার করেছেন। কিন্তু যে কানহাইয়াকে ছাত্র সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছিল, ভোটের ফল বেরোনোর পর দেখা গেল, ৪ লক্ষেরও বেশি ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন বিজেপির গিরিরাজ সিংহের কাছে।
অন্যদিকে, সারা ভারতের নজর কেড়েছিল বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে কৃষকদের লং মার্চ। মহারাষ্ট্র থেকে শুরু হলেও, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কেন্দ্রীয় সরকারি বঞ্চনার প্রতিবাদে পথে নেমেছেন হতদরিদ্র কৃষক সমাজ। লাল ঝাণ্ডা কাঁধে মাইলের পর মাইল হেঁটেছেন তাঁরা। দিল্লি থেকে মুম্বই, সিঙ্গুর থেকে রাজস্থান, নিজেদের দাবি আদায়ে বারবার কৃষকদের রাজপথমুখী করেছেন কৃষক নেতা অমরা রাম। এবার কৃষকদের দাবি দাওয়াকে সংসদে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে রাজস্থানের শিকার কেন্দ্রে ভোটে লড়েছিলেন সিপিএমের অমরা রাম। কিন্তু দেখা গেল, মোদী ঝড়ের সামনে দাঁড়াতে পারলেন না অমরা রামের মতো দাপুটে কৃষক নেতাও। হারলেন বিজেপি প্রার্থীর কাছে। অমরা রাম যেখানে মাত্র ২.৩৭ শতাংশ ভোট পেয়েছেন, সেখানে বিজেপি পেয়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ ভোট।
একইভাবে মোদীর তীব্র বিরোধীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম অভিনেতা প্রকাশ রাজ। তিনিও বেঙ্গালুরু সেন্ট্রাল থেকে নির্দল হিসেবে ভোটে লড়ে শোচনীয় পরাজয়ের মুখে পড়েছেন।
গৈরিক আগ্রাসনের মুখে পড়ে আগেই দেশে বাম গণতান্ত্রিক দলগুলোর শক্তিক্ষয় হচ্ছিল, ২৩ শে মের পর দেশ থেকে তা কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। একদিকে সংসদীয় বামপন্থী দলগুলোর মুখ থুবড়ে পড়া, অন্যদিকে বাম মনোভাবাপন্ন উদারনৈতিক মানুষদের লড়াই ব্যর্থ হওয়া, এর প্রভাব ছাত্র সমাজ কিংবা কৃষিজীবীদের মধ্যে কতটা পড়বে, বা আদৌ পড়বে কিনা, তা বুঝতে অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুদিন।
আর এখানেই উঠছে সেই অমোঘ প্রশ্ন। তাহলে কি কৃষকদের দুর্দশা নিয়ে যা বলা হচ্ছে, বাস্তব পরিস্থিতি তার চেয়ে ভালো? ফসলের ন্যায্য মূল্য কি পাচ্ছেন দেশের অন্নদাতারা? দেশের উচ্চশিক্ষায় যে সঙ্কটের অভিযোগ করছেন কানহাইয়া কুমাররা, তা কি স্রেফ ভোটে জেতার খাতিরে? সারা দেশে দলিত এবং সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ নিয়ে কানহাইয়া কুমার থেকে জিগনেশ মেবানিরা যে আন্দোলনের কথা বলছেন, তা কি সত্যিই অপ্রয়োজনীয়? কী বলছে বাস্তব? মোদী সরকারের সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, কি প্রকৃত অর্থেই সত্য? ২৩ শে মে ভোটের ফল বেরোনোর পর এখন প্রশ্ন উঠছে উপরোক্ত ইস্যুগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই। তাহলে কি মোদী নির্দেশিত পথ ভিন্ন রাস্তা নেই? বিশ্রী হারের মুখে পড়েও মনোবল হারাচ্ছেন না তাঁরা। বুকে নতুন উদ্যম ভরে বলে উঠছেন, সব লড়াইয়ে সব সময় জয় আসে না, তা বলে লড়াই ছাড়লে চলে?
Comments are closed.