বিরলতম বন্ধুর মৃত্যুতে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ সহপাঠীদের! শুভ্র মিত্র মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন সাহায্য করবে দুঃস্থ পড়ুয়াদের, করবে শহরের ইতিহাস চর্চা
কারও কাছে ঘনা দা, কারও আবার সিধু জ্যাঠা, কেউ বলতো পাগলা দাশু। শুভ্র মিত্র। নামে রয়েছে বন্ধু, সে সবারই মিত্র, বাই ডিফল্ট।
ঠিক এক বছর আগে, ৪৪ বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান পাঠভবন, নরেন্দ্রপুরের প্রাক্তনী শুভ্র মিত্র। কাজ করতেন বিজ্ঞাপন সংস্থায়। কিন্তু কী পড়তেন, কী করতেন, তা দিয়ে যে শুভ্র মিত্রকে বোঝা যায় না, তাই বোঝালেন তাঁর বন্ধুরা।
১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ শুভ্র মিত্র ওরফে বাপ্পার শরীরটাই গেছে কেবল, তিনি আছেন বিলক্ষণ। বিরলতম বন্ধু শুভ্রর বহু সহপাঠী, বন্ধু এই দিনটিকে বেছে নিয়েছেন তাঁর জীবন উদযাপনের জন্য। একই সঙ্গে শুভ্রর বন্ধুরা নিয়েছেন এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। এদিনই ডানা মেলা শুরু এক উদ্যোগের। দুঃস্থ পড়ুয়াদের আর্থিক সহায়তা থেকে কলকাতার ইতিহাস চর্চা, ক্যুইজ, নানাবিধ কাজ করবে শুভ্র মিত্র মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন (https://www.subhromemorial.org/)।
১ সেপ্টেম্বর ২০২০, শুভ্রর মৃত্যুর ঠিক এক বছরে বৃষ্টিভেজা ভাদ্রের সন্ধ্যায় শুভ্র ওরফে বাপ্পার বন্ধুরা সোশ্যাল মিডিয়ায় এক অনুষ্ঠানে গানে-কথায় ফিরিয়ে আনলেন তাঁকে। কেউ গাইলেন জানি, জানি বন্ধু জানি, তোমার আছে তো হাতখানি। কেউ হাঁটা দিলেন স্মৃতির সরণি ধরে। স্কুল ড্রেসে প্রথম সিগারেট হয়ে কথার ধোঁয়া কখন যে পৌঁছল ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যালের জটিল সুরারোপণে, আবার পরক্ষণেই সুরের ভেলায় পাড়ি দিল রাজ্য রাজনীতির সদা উত্তেজিত অলি-গলিতে, হিসেব রাখা মুশকিল। নিজের ওই ছোট্ট সীমিত জীবনকালে শুভ্র মিত্র কী ফেলে গেলেন, এক ঘণ্টা ৪০ মিনিটের ভার্চুয়াল মিট সেই বৃত্তান্তেরই স্বতঃস্ফূর্ত খনন।
কিন্তু কে শুভ্র মিত্র, যাঁর মৃত্যুতে তাঁর বন্ধুরা নিলেন এমন অভিনব উদ্যোগ? কিংবা শুভ্র কেমন? সেটাই বললেন তাঁর সমবয়সী কিংবা শিক্ষক কিংবা দাদা-কাকারা। কঠিন কথাটা সবচেয়ে সহজে বললেন, শুভ্রর চেয়ে ২০ বছরের ছোট ঋতুপর্ণা। বাপ্পা মামা আমাকে কোনওদিন বুঝতে দেয়নি আমাদের বয়সের ফারাক ২০ বছর। শুভ্র বয়সের বাধা মানতেন না। স্বভাবতই অসম বয়সী দুজনের বন্ধুত্বে কখনও ছায়া ফেলতে পারেনি বয়স আরোপিত গাম্ভীর্য। আর ঠিক এই কারণেই শুভ্রর বন্ধু তালিকায় সাত থেকে সত্তরের উপস্থিতি।
পার্ক স্ট্রিটের অলি পাব ছিল শুভ্রর আড্ডা। সেখানে গেছেন কিন্তু শুভ্রকে দেখেননি এমন মানুষ সংখ্যালঘু। আর টেবিলজুড়ে পৃথিবীর হেন বিষয় নেই, যা নিয়ে বিদগ্ধ আলোচনা হচ্ছে না। হীরে-জহরতের কারবারি থেকে আর্ট ফিল্মের ডিরেক্টর, সাংবাদিক থেকে আর্টিস্ট, সকলকে ঘিরে মধ্যমণি হয়ে বসে শুভ্র মিত্র। গিলতে আপত্তি না হলেও মদ নিয়ে লিখিত আলোচনায় মধ্যবিত্ত বাঙালির চিরকালের অনীহা। তাই প্রসঙ্গ বিস্তারের পথে না গিয়ে বরং শুভ্রর মদের পাল্লাটা বলি। ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে শুভ্রর এক গুণমুগ্ধ শোনালেন সে কথা। আমি নিলাম এক পেগ রাম। আর শুভ্রর জন্য হাজির হল একটি ফাঁকা গেলাস। তাতে প্রথমে পড়ল এক পেগ ভডকা, তারপর এক পেগ হুইস্কি, এক পেগ রাম। শুভ্র তাই খেল গোটা দুয়েক।
শুভ্রকে নিয়ে আলোচনার পাশাপাশিই সোশ্যাল মিডিয়ায় চলছিল তাঁর স্মৃতিতে বন্ধুদের উদ্যোগের কাজ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা। বন্ধুদের এই উদ্যোগের শুরুটা ফেসবুকে শুভ্রর নামে তৈরি একটি পেজ দিয়ে। তারপর ক্রমশ তা ডালপালা মেলার পথে। শুভ্র মিত্র মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের তরফ থেকে দুঃস্থ পড়ুয়াদের আর্থিক সহায়তা করা হবে। এছাড়াও শুভ্রর পছন্দের ক্যুইজ, কলকাতার ইতিহাস, নগরজীবন নিয়েও বিশদে কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে বন্ধুদের। সে জন্য আর্থিক সহায়তার আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা। ভারতে বসবাসকারীদের পাশাপাশি বিদেশ থেকে সাহায্য করতে ইচ্ছুক মানুষেরা পৃথক গেটওয়ে দিয়ে তা করতে পারবেন। পুরো লেনদেনই হবে অনলাইনে। নগদের কোনও ব্যবস্থা নেই।
শুভ্র সশরীরে নেই। কিন্তু দুনিয়াজুড়ে ছড়ানো ছেটানো বন্ধুদের ভাবনা জুড়ে সে আছে। আছে পাঠভবনের ইউনিফর্মে, আছে যাদবপুরের আড্ডায়, অলি পাবের ছলকে ওঠা কাচের গেলাসে। শুভ্র বেঁচে থাকবে তাঁর মৃত্যুর এক বছরে বন্ধুদের নতুন সংকল্পের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আর প্রশ্ন করে যাবে, বেলা না যেতে খেলা কেন তব যায় ঘুচে…
Comments are closed.