দারিদ্র, হাজার প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন দৃষ্টিহীন বুদ্ধদেব জানার, জাতীয় দৃষ্টিহীন জুডো প্রতিযোগিতায় সোনা, কমওয়েলথে ব্রোঞ্জ!

চোখে দৃষ্টিশক্তি প্রায় নেই বললেই চলে। তবে সেই প্রতিবন্ধকতা মাথাতেই রাখেন না বছর কুড়ির বুদ্ধদেব জানা। বরং একটা কথা সব সময় মেনে চলেন, প্রতিবন্ধী হিসেবে নয়, তাকে প্রতিষ্ঠা পেতে হবে সাধারণ, স্বাভাবিক মানুষের সঙ্গে লড়াই করেই।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার হেঁড়িয়ার ছেলে বুদ্ধদেব। ছোটবেলা থেকেই চোখে প্রায় কিছুই দেখতে পেত না। তার বাবা ছোট্ট একফালি জমিতে কৃষি কাজ করেন। তাঁর পক্ষে ছেলের চিকিৎসার খরচ জোগানো সম্ভব নয়। তখনই এগিয়ে আসেন বুদ্ধদেবের ছোট কাকা। চেন্নাই, বেঙ্গালুরুতে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যান বুদ্ধদেবকে। তবে খুব একটা লাভ হয়েছে তা নয়। বরং কলকাতার হাসপাতালে চোখে লেন্স বসিয়ে অল্প হলেও দৃষ্টিশক্তি বেড়েছে তাঁর।
তবে এত বড় প্রতিবন্ধকতা কখনওই হারাতে পারেনি বুদ্ধদেবকে। বরাবরই পড়াশোনায় দারুণ। ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় চলে আসে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের ব্লাইন্ড বয়েজ একাডেমিতে। ২০১৮ সালে মাধ্যমিকে চমকে দেওয়ার মত নম্বর। সেরা সাতটি বিষয়ে, বুদ্ধদেবের মোট নম্বর ৬১৪। ওর খুব ইচ্ছা ছিল বিজ্ঞান নিয়ে পড়বে। তবে দৃষ্টিহীন ছাত্র-ছাত্রীদের বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার পরিকাঠামো এ রাজ্যে এখনও তৈরি হয়নি। তাই বাধ্য হয়েই বুদ্ধদেব ভর্তি হয়েছে কলা বিভাগে। এখন ওর স্বপ্ন আইনজীবী হবে। ইতিমধ্যেই প্রস্তুতিপর্ব শুরু করে দিয়েছ সে।
তবে এই পড়াশোনার বাইরেও বুদ্ধদেবের একটা মস্ত বড় পরিচয় আছে। ভারতকে ইতিমধ্যেই সে গর্বিত করেছে। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের বাকিদের সঙ্গেই সাঁতার শেখা শুরু হয়েছিল তার। প্রথমে স্টেট লেভেল এবং পরে রাজ্যের গণ্ডি টপকে ২০১৩ সাল থেকে জাতীয় স্তরের সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে বুদ্ধদেব। ২০১৩-১৭ বিভিন্ন জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতায় জিতেছে একাধিক পদক।
সাঁতারের পর জুডো। ক্লাস নাইন থেকে স্কুলে জুডো শেখা শুরু তার। খুব অল্প সময়েই জুডোর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যায়। ২০১৮ সালের জাতীয় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ থাকলেও তখন মাধ্যমিক পরীক্ষা চলায় যেতে পারেনি। মাধ্যমিকের পর ছুটিতে বুদ্ধদেব আলাদা প্রশিক্ষণ নেয় নরেন্দ্রপুরে জুডো শেখাতে আসা প্রশিক্ষক দিব্যেন্দু হাটুয়ার কাছে। তারপর আর তাকে থামতে হয়নি। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে গোরক্ষপুরে আয়োজিত জাতীয় দৃষ্টিহীন জুডো প্রতিযোগিতায় সোনা জেতে বুদ্ধদেব। সুযোগ পায় বার্মিংহামে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ জুডো চ্যাম্পিয়নশিপে। কিন্তু সমস্যা তৈরি হয় অর্থ নিয়ে। প্রতিযোগিতায় যাওয়ার খরচ প্রায় ১ লক্ষ ১৩ হাজার টাকা। জুডোর পোশাকের খরচ আরও ২০ হাজার টাকা। এত টাকা অত্যন্ত দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা বুদ্ধদেবের পক্ষে জোগাড় করা অসম্ভব। এই সময় এগিয়ে আসেন নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের প্রিন্সিপাল। বুদ্ধদেবের জন্য তিনি যোগাযোগ করেন হিন্দুস্তান কপার লিমিটেডের সঙ্গে। তারা রাজি হয়ে যায় পুরো টাকা দেওয়ার জন্য। বার্মিংহামে যায় বুদ্ধদেব। প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় গিয়ে হতাশ করেনি বুদ্ধদেব, দেশের হয়ে জিতেছে ব্রোঞ্জ।

তবে এখানেই থামতে চায় না বুদ্ধদেব। এগিয়ে যেতে চায় আরও অনেক দূর। বুদ্ধদেব বলছে, ‘আমার কোনও প্রতিবন্ধকতা আছে ভাবি না কখনও। সবার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই আমি এগিয়ে যেতে চাই। আশা করব আমি আমার লক্ষ্যে সফল হতে পারব।’ আপাতত উচ্চ মাধ্যমিকে চমকে দেওয়া ফল করার জন্য পড়াশোনা করছে বুদ্ধদেব। সঙ্গে অবশ্যই আগামী দিনেও জুডো প্রতিযোগিতায় দেশের নাম উজ্জ্বল করার স্বপ্ন তাঁর।

Comments are closed.