মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইংরেজি নিয়ে ট্যুইট করে সূর্যকান্ত মিশ্র যে সমালোচনার মুখে পড়ছেন তা তাঁর প্রাপ্য নয়, এটা সিপিএমের পরম্পরা মাত্র
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম না করে তাঁর ইংরেজি উচ্চারণ নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক ট্যুইট করার জন্য যাঁরা সোশ্যাল মিডিয়ায় সিপিএম রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রর সমালোচনা করছেন, দুটি কারণে আমি তাঁদের সঙ্গে একমত নই। প্রথমত, আমি মনে করি না, সূর্যকান্ত মিশ্র যে ট্যুইট করে ট্রোলড হচ্ছেন, তার জন্য এতটা সমালোচনা তাঁর প্রাপ্য। দ্বিতীয়ত, ব্যক্তি সূর্যকান্ত মিশ্রকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। ইংরেজি জানা-না জানা নিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করা যায়, একথা ব্যক্তি সূর্যকান্ত মিশ্র বিশ্বাস করেন, তা আমি এখনও মনে করি না।
তো কী ট্যুইট করেছেন সিপিএম রাজ্য সম্পাদক, যা নিয়ে এত আলোচনা হচ্ছে? গত ২৯ শে এপ্রিল কিছু ইংরেজি শব্দ লিখে তিনি ট্যুইট করেছিলেন, যেখানে R অক্ষরটি ছিল না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম না করে তাঁর ইংরেজি উচ্চারণকে ব্যঙ্গ করেন সূর্যকান্ত মিশ্র।
কিন্তু কেন বলছি, এই ট্যুইটের জন্য এতটা সমালোচনা প্রাপ্য নয় সিপিএম রাজ্য সম্পাদকের? কারণ, সিপিএমের আমলে ইংরেজি তুলে দেওয়া থেকে শুরু করে যে সব কারণে সোশ্যাল মিডিয়ায় আজ সূর্যকান্ত মিশ্রর সমালোচনা হচ্ছে আমি তার সঙ্গে একমত নই।
কারণ, খুব সহজ। এই ট্যুইটকে আমি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখছি না। দেখছি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে সিপিএমের মূল্যায়নের একটা ধারাবাহিক পরম্পরা হিসেবে। এবং যাঁরা এই লেখা পড়ছেন তাঁরা মানুন আর নাই মানুন, একথা বলতে আমার কোনও দ্বিধা নেই, ১৯৯৮ সালে তৃণমূল কংগ্রেস গড়ে ওঠার পর থেকে গত ২১ বছরে সিপিএম নেতারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে যে ধরনের সব মন্তব্য করেছেন, তার তুলনায় এই লোকসভা নির্বাচন চলাকালীন সূর্যকান্ত মিশ্রর ট্যুইট নেহাতই বালক মাত্র। কেন বলছি একথা?
আমার তখন সাংবাদিকতা পেশায় দু’তিন বছর হয়েছে মাত্র। তখন তো সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না, একদিন দেখলাম বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বললেন, ‘ওনার নাম মুখে আনতে আমার রুচিতে বাধে’।
এখন আর ঠিক মনে নেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের এই মন্তব্যের আগে না পরে, তবে কাছাকাছি সময়েই হবে, ঘটল আর একটা ঘটনা। গড়বেতার চমকাইতলায় মিটিং করতে গেছেন তৃণমূল নেত্রী। সভা চলাকালীন তুমুল বৃষ্টি। ভিজেই সভা শেষ করলেন তিনি। পরদিন শুনলাম, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে সিপিএমের এক নেতা বলেছেন, ‘রাম তেরি গঙ্গা মইলি’। বৃষ্টিতে ভেজা মমতা বন্দ্যোপাধ্যাকে মন্দাকিনীর সঙ্গে তুলনা করে সিপিএম নেতাদের সে কি আনন্দ!
তার কিছুদিন পরে ২০০১ বিধানসভা নির্বাচনের আগে হাওড়ার ডুমুরজলা মাঠে জ্যোতি বসুর নির্বাচনী সভা। তার ঠিক আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপিকে ছেড়ে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করেছেন। সমাবেশে জ্যোতি বসু বললেন, ‘উনি তো দ্রৌপদীর মতো। আজ এর সঙ্গে আছেন, কাল ওর সঙ্গে আছেন, ওনার রাজনীতি নিয়ে আর কী বলব’। মাঠে সিপিএম কর্মী-সমর্থকরা সেদিন সেভাবেই হাততালি দিচ্ছিলেন, যেভাবে তাপস পাল ‘ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে ধর্ষণ’ করিয়ে দেব বলার পর তৃণমূল কর্মীরা হাততালি দিচ্ছিলেন।
ব্যাস, শুরু হয়ে গেল সিপিএম নেতাদের মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে কুকথার প্রতিযোগিতা। এবং শুরু হল সর্বোচ্চ লেভেল থেকে। এমন নয় যে ঠিকাদারি করতে করতে পার্টিতে ঢুকে পড়া কেউ এই কথাগুলো বললেন।
তার কিছুদিন পরের কথা। কোনও জেলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কনভয়ে হামলার অভিযোগ ওঠে সিপিএমের বিরুদ্ধে। তৃণমূল নেত্রী এই ঘটনা নিয়ে সিপিএমকে তীব্র আক্রমণ করেন এবং বলেন, তাঁকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করেছিল সিপিএম। পরদিন এই কথা উল্লেখ করে সিপিএমের তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাসকে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে প্রশ্ন করেন সাংবাদিকরা। ঠান্ডা মাথার জন্য পার্টিতে বিশেষ সুনাম অর্জন করা অনিল বিশ্বাস জবাব দিয়েছিলেন, ‘কে ওনাকে মারবে? উনি যমেরও অরুচি’।
তৃণমূল নেত্রী সম্পর্কে সিপিএম নেতাদের এই সব কথা শুনতে শুনতেই সাংবাদিক জীবনের বয়েস বাড়ছিল আমার প্রজন্মের। এরপর কখনও অনিল বসুর মন্তব্য, তো কখনও আনিসুর রহমানের সেই সহজ সরল প্রশ্ন, ‘উনি তো বিয়ে করেননি, সিঁদুরও পরেননি। কীভাবে বুঝবেন লাল রঙের গুরুত্ব’? যাঁদের স্মৃতিশক্তি মোটামুটি ভদ্রস্থ তাঁরা নিশ্চিতভাবেই মনে রাখতে পেরেছেন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সাংবাদিক সম্মেলন শেষ করে তৃণমূল নেত্রীকে উদ্দেশ্য করে বিমান বসুর অঙ্গভঙ্গি।
তাই আবারও বলি, যে ট্যুইটকে ঘিরে সোশ্যাল মিডিয়ায় আজ সমালোচনার মুখে পড়ছেন সূর্যকান্ত মিশ্র, আমি মনে করি তা তাঁর প্রাপ্য নয়। বরং তাঁর পূর্বসুরীরা তৃণমূল নেত্রীকে নিয়ে মন্তব্যের যে পরম্পরা তৈরি করেছেন সূর্যকান্ত মিশ্র তার তুলনায় পরিস্থিতির অনেক উন্নতি ঘটিয়েছেন। এমন একটা জিনিস নিয়ে সিপিএম রাজ্য সম্পাদক তৃণমূল নেত্রীর সমালোচনা করেছেন, যা তিনি ভাল জানেন না বলে খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই একাধিকবার প্রকাশ্যে বলেছেন। যে কেউই নিশ্চয় মানবেন, ‘রাম তেরি গঙ্গা মইলি’, ‘দ্রৌপদীর পাঁচ স্বামী’ বা ‘যমের অরুচি’র তুলনায় অনেক কম অপমানজনক সঠিক ইংরেজি না জানা।
Comments are closed.