সিপিএমকে অনুরোধ, নন্দীগ্রামবাসীকে ১৪ মার্চ মনে করাবেন না! মীনাক্ষীর ভোট কমে যাবে

রাজ্য রাজনীতিতে আবার প্রাসঙ্গিক নন্দীগ্রাম। যে নন্দীগ্রাম আমার সাংবাদিক জীবনের সেরা শিক্ষকের নাম। যে নন্দীগ্রামের একাধিক ঘটনা বারবার আমাকে বিস্মিত করেছে, বোকা বানিয়েছে। সেই নন্দীগ্রাম আবার আলোচনায়, কারণ দশ বছর সরকার চালিয়ে মমতা ব্যানার্জি নিজের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য বেছে নিয়েছেন নন্দীগ্রামকে।

নন্দীগ্রাম নিয়ে এই বিধানসভা নির্বাচনের আগে কিছু লিখব বলে ভাবিনি। যদিও গত ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে একবার এবং মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে একবার, সম্প্রতি মোট দু’বার আমি নন্দীগ্রাম গিয়েছি। কিন্তু সেখানে ভোটের কী অবস্থা এবং মমতা ব্যানার্জি-শুভেন্দু অধিকারী-মীনাক্ষী মুখার্জির লড়াইয়ে কে কোথায় দাঁড়িয়ে তা আলোচনার জন্য এই লেখা নয়। এই লেখা ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ নিয়ে, যেদিনের কিছু ঘটনা নিয়ে ২৮ মার্চ ২০২১, সোমবার নন্দীগ্রামে কিছু কথা বলেছেন মমতা ব্যানার্জি। এবং তাঁর মন্তব্যের পরই ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে নন্দীগ্রাম নিয়ে। ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ নিয়ে ফের ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব সামনে এনেছে সিপিএম।
কিন্তু কী ঘটেছিল নন্দীগ্রামে?

আমি সেই সময় স্টার আনন্দ (পরবর্তীকালে এবিপি আনন্দ) চ্যানেলের সাংবাদিক। ২০০৭ সালের ৩ জানুয়ারি থেকে ধারাবাহিকভাবে নন্দীগ্রামে যাচ্ছিলাম। যখন কলকাতায় থাকতাম তখনও নন্দীগ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা এবং পূর্ব মেদিনীপুরের কয়েকজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে প্রায় নিয়মিত কথা বলতাম। ১৩ মার্চ দুপুরে আমি অফিসে বসে, পূর্ব মেদিনীপুরের এক পুলিশ অফিসার আমাকে ফোন করে জানান, পরদিন মানে ১৪ মার্চ নন্দীগ্রামে পুলিশ অপারেশন হবে। ব্যাপক গণ্ডগোল হতে পারে। আমি জিজ্ঞেস করি, কেন এমন মনে হচ্ছে? তিনি বলেন, কোলাঘাটে ব্রিফিং হয়েছে সিনিয়র অফিসারদের। অন্য জেলা থেকে ফোর্স আসছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টা জানাই অফিসে। তারপর বিকেল সাড়ে ৫ টা নাগাদ কলকাতা থেকে রওনা দিই পূর্ব মেদিনীপুরের উদ্দেশে। আমার সঙ্গী ছিলেন ক্যামেরা পার্সন সৌমেন পান। যাওয়ার পথে অনেক অফিসারকে ফোন করি। তাঁদের মধ্যে ছিলেন রাজ্যের আইজি আইন-শৃঙ্খলা রাজ কানোজিয়া, পূর্ব মেদিনীপুরের এসপি অনিল শ্রীনিবাস থেকে শুরু করে অনেকে। কেউই কিছু বলতে চাননি। আমাকে যে অফিসার খবর দিয়েছিলেন, তিনি আমাকে বলেন, কিছু বুঝতে পারছি না কী প্ল্যানিং। নন্দীগ্রাম থেকে খবর পাচ্ছি, মানুষ বাধা দেবে।

সেদিন রাতে নন্দীগ্রামে না গিয়ে তমলুকে রাতটা থাকব বলে ঠিক করি। এখন অনেকেরই নাও মনে থাকতে পারে, সেই সময় স্টার আনন্দ চ্যানেলকে রীতিমতো টার্গেট করে ফেলেছিলেন জমি আন্দোলনকারীরা। আগের বছর মমতা ব্যানার্জির অনশন কভার করতে ধর্মতলায় গিয়েও তৃণমূল কর্মীদের ক্ষোভের মুখে পড়েন বহু সাংবাদিক। ২০০৭ সালেই ফেব্রুয়ারি মাসে আমি নিজে সিঙ্গুরে মমতা ব্যানার্জির মিটিং কভার করতে গিয়ে আক্রান্ত হই। স্টার আনন্দর ওবি ভ্যান ভাঙচুর করা হয়। ২০০৭ সালের জানুয়ারি থেকে নন্দীগ্রামে যাওয়ার অভিজ্ঞতায় ১৩ মার্চ সন্ধেবেলা আমার মনে হয়েছিল, রাতে নন্দীগ্রামে ঢোকা ঠিক হবে না। কিন্তু হোটেলে না গিয়ে সন্ধে ৭ টা নাগাদ আমি যাই তমলুকের হাসপাতাল মোড়ে সিপিএমের জেলা অফিসে।

লক্ষ্মণ শেঠের সঙ্গে দেখা করতে চেয়ে অপেক্ষা করি পার্টি অফিসের বাইরে। একজন বলেন, ভেতরে মিটিং চলছে। ঘণ্টাখানেক বাদে অফিসের ভেতরে ডাক পড়ে আমার। ঘরে তখন বসেছিলেন তমলুকের তৎকালীন সাংসদ লক্ষ্মণ শেঠ, জেলা সম্পাদক কানু সাহু এবং জেলার আরও দুজন নেতা নির্মল জানা ও নিরঞ্জন সিহি। লক্ষ্মণ শেঠ আমাকে বলেন, কাল নন্দীগ্রামে গিয়ে কী করবেন? পুলিশ গিয়ে রাস্তা ঠিক করুক, তারপর না হয় যাবেন।

তখনও বুঝতে পারিনি কেন লক্ষ্মণ শেঠ আমাকে ১৪ মার্চ নন্দীগ্রাম যেতে না করেছিলেন। বুঝতে পারি পরদিন ভোর ৫ টায়। সাড়ে ৪ টেয় হোটেল থেকে বেরিয়ে সাড়ে ৫ টা নাগাদ নন্দীগ্রামে ঢোকার মুখে চন্ডিপুরে পৌঁছে। ওই সকালে বাঁশ দিয়ে ব্যারিকেড করে লাল পতাকা লাগিয়ে অন্তত ১০০ জন সিপিএমের ছেলে রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে। সবার এক কথা, আজ নন্দীগ্রামে ঢোকা যাবে না। কিন্তু কেন? উত্তর নেই।

প্রায় আধ ঘণ্টা নন্দীগ্রামে ঢোকার বৃথা চেষ্টা করে চন্ডিপুর ছেড়ে এগোলাম হেঁড়িয়ার দিকে। যদি খেজুরি দিয়ে ঢোকা যায়। হেঁড়িয়ার মোড় থেকে একশো মিটার এগোলেই বাঁদিকে দোতলা সিপিএম অফিস। সেখানেও এক ছবি, সিপিএমের ছেলেরা লাঠি, বাঁশ হাতে রাস্তা পাহারা দিচ্ছে। সংবাদমাধ্যমের প্রবেশ নিষেধ। নেতাগোছের একজন এগিয়ে এসে বললেন, আপনি তো বিতনু দা। আজ ছেড়ে দিন। কাল যাবেন। জিজ্ঞেস করলাম, আপনি? আমার নাম বিনয়।

১৪ মার্চ সারাদিন বহু চেষ্টা করে নন্দীগ্রামে ঢুকতে পারিনি। ঢুকতে দেয়নি সিপিএম। কেন, তা নন্দীগ্রামের গোকুলনগর, অধিকারীপাড়া, সোনাচূড়া, ভাঙাবেড়ার মানুষ জানেন। আর জানেন লক্ষ্মণ শেঠ, খেজুরির হিমাংশু দাস, বিজন রায়রা। আমি শুধু একজনের কথা বলব, যা অনেকেই জানেন না। হ্যাঁ, যাঁরা সোশ্যাল মিডিয়ায় আজ নন্দীগ্রাম নিয়ে সরব হয়েছেন তাঁরা তো বটেই, নন্দীগ্রামের অনেক মানুষও জানেন না।

সেই ব্যক্তির আসল নাম প্রকাশ করব না। এটা আমার নীতিগত অবস্থান। তাঁর বাড়ি গড়বেতায়। চন্দ্রকোনায় গিয়ে সেই ব্যক্তির সঙ্গে আমি ২০১৪ সালে দেখা করি। তিনি ছিলেন সিপিএমের সদস্য এবং প্রথম সারির নেতা। কেশপুর-গড়বেতা পুনরুদ্ধারের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। তাঁকে ২০০৭ সালের জানুয়ারির শেষে সিপিএম দায়িত্ব দিয়েছিল নন্দীগ্রাম উদ্ধার করে দেওয়ার। তিনি নন্দীগ্রামের রেয়াপাড়া এবং খেজুরির কলাগেছিয়ায় পালা করে থাকতেন। ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য সিপিএমের ছেলেদের বন্দুকের প্রশিক্ষণ দিতেন তিনি এবং পরবর্তী সময়ে গড়বেতা থেকে ছেলে নিয়েও গিয়েছিলেন নন্দীগ্রাম উদ্ধারের জন্য। তিনি আমাকে ২০১৪ সালে বলেছিলেন, ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ তিনি ছিলেন কলাগেছিয়ায়। পুলিশ অভিযানের পর তাঁর ছেলেরাই নন্দীগ্রামে ঢুকেছিল আন্দোলনকারীদের সবক শেখাতে। এছাড়াও তিনি আমাকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে আর যা যা বলেছিলেন তা আমি নন্দীগ্রাম নিয়ে আমার বইয়ে লিখেছি।

এই ব্যক্তির নাম প্রকাশ করে আমি ১৪ মার্চ সিপিএম নন্দীগ্রামে কী করেছিল তার সত্যতা বৃদ্ধির চেষ্টা করব না। শুধু এটুকু বলব, পার্টির জন্য একাধিকবার নিজের জীবন বিপন্ন করা এই ব্যক্তি এখন বাড়িবন্দি। শালবনির সিপিএম প্রার্থী সুশান্ত ঘোষ সম্প্রতি তাঁর বাড়ি যান। তাঁকে ভোটের কাজে নামতে অনুরোধ করেন। তিনি কী উত্তর দিয়েছেন তা নন্দীগ্রামের লেখায় প্রাসঙ্গিক নয়। ২০০৯ সালের শেষে বা ২০১০ এর শুরুতে হবে, এক সন্ধ্যায় পশ্চিম মেদিনীপুরের এনায়েতপুরে সিপিএম অফিস আক্রমণ করেছিল মাওবাদীরা। খবর পেয়ে এই ব্যক্তি চন্দ্রকোনা থেকে কয়েকজনকে নিয়ে এনায়েতপুরে পৌঁছন। সারা রাত মাওবাদীদের সঙ্গে লড়াই করেন বন্দুক নিয়ে। সেই এনকাউন্টারে সিপিএমের দু’জন গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। এই ব্যক্তি না থাকলে সিপিএমের অনেকেই সেদিন মারা যেতেন। যাক, সেই ঘটনাও এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। কিন্তু নন্দীগ্রামে ১৪ মার্চ ২০০৭ কী ঘটেছিল তা তিনি জানেন। আর নিশ্চিতভাবে জানেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। যিনি ২০০৭ সালের নভেম্বরে অপারেশন সূর্যোদয়ের কয়েকদিন বাদে দিল্লিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে প্রথম বলেছিলেন, নন্দীগ্রামে আমাদের প্রশাসনিক, সাংগঠনিক এবং রাজনৈতিক ভুল হয়েছে।

১ এপ্রিল ২০২১ নন্দীগ্রামে নির্বাচন। ২০০৭ সালের ক্ষত মুছে ফেলে এবার নন্দীগ্রামে লড়ছেন মীনাক্ষী মুখার্জি। সম্প্রতি পরপর দু’বার নন্দীগ্রামে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, মানুষ ২০০৭ সালের সেই একটা বছর অনেকটাই ভুলে গিয়েছেন। আর এই ২০০৭ সাল ভুলে যাওয়াই এবার সিপিএমের ভোট বৃদ্ধির একমাত্র কারণ হতে পারে। সিপিএমকে অনুরোধ, তৃণমূল-বিজেপির গোলমালে জড়িয়ে পড়ে নন্দীগ্রামের মানুষকে ২০০৭ আর মনে করিয়ে দেবেন না। তাতে মীনাক্ষীর ভোট কমে যাবে। নন্দীগ্রামের মানুষ নিজের জীবনের অভিজ্ঞতায় ২০০৭ সালের ৩ জানুয়ারি থেকে ১০ নভেম্বর আমার, আপনার থেকে ঢের বেশি জানেন।

Comments are closed.