ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের শীর্ষপদে উচ্চবর্ণের রমরমা, অক্সফাম ইন্ডিয়া এবং দ্য মিডিয়া রাম্বলের সমীক্ষায় উঠে এল এক বাস্তব চিত্র
জাতিভেদ প্রথা কতটা খারাপ, তা বলছে সংবাদমাধ্যম। কিন্তু সংবাদমাধ্যম কি আদৌ জাতিভেদ মুক্ত? বাস্তব বলছে, ভারতের প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমের অভ্যন্তরে কেবলমাত্র উচ্চবর্ণেরই রমরমা।
অক্সফাম ইন্ডিয়া এবং দ্য মিডিয়া রাম্বলের যৌথ উদ্যোগে দেশের সংবাদমাধ্যমের কর্তা-ব্যক্তিদের জাতি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। আর তাতে উঠে এসেছে চোখ কপালে তোলা তথ্য। দেখা যাচ্ছে, দেশের প্রতি ৪ জন নিউজ অ্যাঙ্কার বা প্রেজেন্টারের মধ্যে ৩ জনই উচ্চবর্ণের। একজনও দলিত, আদিবাসী কিংবা ওবিসি নেই। ১২ টি ম্যাগাজিনের ৯৭২ টি প্রতিবেদনের মধ্যে মাত্র ১০ টি আর্টিকেল জাতিভেদ সম্পর্কিত। ইংরেজি সংবাদপত্রগুলোতে এ বিষয়ে যত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যে ৫ শতাংশেরও কম লিখেছেন দলিত কিংবা আদিবাসীরা।
সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হল, সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, নিউজ চ্যানেল, সংবাদপত্র, ওয়েবসাইট নিউজ প্ল্যাটফর্ম কিংবা ম্যাগাজিন, নিউজ রুমে সর্বোচ্চ পদ, যেমন এডিটর ইন চিফ, ম্যানেজিং এডিটর, এক্সিকিউটিভ এডিটর, ব্যুরো চিফ, ইনপুট বা আউটপুট এডিটর, এমন মোট ১২১ টি গুরুত্বপূর্ণ পদের ১০৬ টিতেই যে সাংবাদিকরা বসে আছেন, তাঁরা উচ্চবর্ণের। এক্ষেত্রেও এসসি বা এসটির কোনও প্রতিনিধিত্ব নেই।
সমীক্ষকরা নিউজ চ্যানেলের ক্ষেত্রে বেছে নিয়েছিলেন ৭ টি হিন্দি এবং ৭ টি ইংরেজি নিউজ চ্যানেলকে। ইংরেজি নিউজ চ্যানেলগুলো হল, সিএনএন-নিউজ-18, ইন্ডিয়া টুডে, মিরর নাউ, এনডিটিভি 24×7, রাজ্যসভা টিভি, রিপাবলিক টিভি এবং টাইমস নাউকে। অন্যদিকে, হিন্দি নিউজ চ্যানেলগুলো হল আজ তক, নিউজ 18 ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া টিভি, এনডিটিভি ইন্ডিয়া, রাজ্যসভা টিভি, রিপাবলিক ভারত এবং জি নিউজ।
সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, ইংরেজি নিউজ চ্যানেলগুলোর ৮৯ শতাংশ উচ্চপদে বসে আছেন অসংরক্ষিত ক্যাটেগরির মানুষ। এই চ্যানেলগুলোর ৭৬ শতাংশ প্রাইম টাইম অ্যাঙ্করও একইভাবে অসংরক্ষিত শ্রেণির।
এই চ্যানেলগুলোর প্যানেল ডিসকাশন বা আলোচনা চক্রে যোগ দেওয়া অতিথিদের মধ্যে মাত্র ৫.৬ শতাংশ তফশিলি জাতিভুক্ত। আর তফশিলি উপজাতিভুক্তদের সংখ্যা ১ শতাংশেরও কম।
সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, রাজ্যসভা টিভিতে শতকরা ৮০ শতাংশ এবং এনডিটিভিতে শতকরা ৭২ শতাংশ আলোচনায় উচ্চবর্ণরাই সংখ্যাগুরু থাকেন। রিপাবলিক টিভিতে এই সংখ্যা ৫০ শতাংশের একটু উপরে এবং টাইমস নাউয়ের ক্ষেত্রে তা ৫৪ শতাংশ।
তাৎপর্যপূর্ণভাবে জাতি নিয়ে আলোচনায় সমস্ত নিউজ চ্যানেলের শতকরা ৬২ জন প্যানেলিস্ট আসেন অসংরক্ষিত বা সাধারণ শ্রেণি থেকে। রাজ্যসভা টিভির ক্ষেত্রে এই হার ৮০ শতাংশ এবং সবচেয়ে কম ইন্ডিয়া টুডেতে, সেখানে ৫৩ শতাংশ অসংরক্ষিত শ্রেণির।
সমীক্ষায় বিশেষভাবে বলা হয়েছে, আলোচনার বিষয়বস্তু যাই হোক না কেন, তফশিলি উপজাতি বা সিডিউল ট্রাইবদের প্রতিনিধিত্ব প্রায় দেখাই যায় না।
হিন্দি নিউজ চ্যানেলগুলোর ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও খারাপ। সমীক্ষায় অংশ নেওয়া সবকটি হিন্দি চ্যানেলের শীর্ষস্থানীয় পদে কর্মরত সাংবাদিকদের ১০০ শতাংশই সাধারণ শ্রেণিভুক্ত। হিন্দি নিউজ চ্যানেলগুলোতে প্রাইম টাইম শো করা অ্যাঙ্করদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা ৮০ শতাংশ।
শুধু নিউজ চ্যানেলই নয়, সংবাদপত্রের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা হুবহু এক। দেশের প্রথম সারির ইংরেজি সংবাদপত্রের একটিতেও পিছিয়ে পড়া শ্রেণির সাংবাদিকরা শীর্ষস্থানীয় পদে নেই। ২০১৮ র অক্টোবর থেকে ২০১৯ র মার্চ অবধি করা সমীক্ষায় ধরা পড়েছে, সবকটি সংবাদপত্র মিলিয়ে এই সময়ের মধ্যে ১৬ হাজারেরও বেশি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। তার মধ্যে ৬০ শতাংশেরও বেশি প্রতিবেদন লিখেছেন উচ্চবর্ণের লেখকরা।
সমীক্ষায় প্রকাশ দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জাতি সমস্যা নিয়ে সবচেয়ে বেশি প্রতিবেদন ছেপেছে। মোট প্রতিবেদনের ৬০ শতাংশই এই ইংরেজি সংবাদপত্রে জাতি সমস্যাভিত্তিক।
হিন্দি সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশ লেখক অসংরক্ষিত শ্রেণির আওতায় পড়েন। তফশিলি জাতি ৮.১ শতাংশ এবং মাত্র ১.১ শতাংশ তফশিলি উপজাতির।
সমীক্ষা করা হয়েছে ১১ টি ডিজিটাল মিডিয়া নিয়েও। তার মধ্যে রয়েছে ফার্স্টপোস্ট, নিউজ লন্ড্রি, স্ক্রোল ডট ইন, স্বরাজ্য, দ্য কেন, দ্য নিউজ মিনিট, দ্য প্রিন্ট, দ্য ক্যুইন্ট, দ্য ওয়্যার, নিউজ লন্ড্রি (হিন্দি), সত্যাগ্রহ (হিন্দি)।
এই ওয়েব পোর্টালগুলোতেও ৮৪ শতাংশ নেতৃস্থানীয় পদেই রয়েছেন সাধারণ শ্রেণির সাংবাদিকরা। পোর্টালের জগতে এসসি বা এসটির কোনও চিহ্নই নেই। আর্টিকেল লেখার ক্ষেত্রে পোর্টালগুলোতে ৫৬ শতাংশই সাধারণ ক্যাটেগরির। দ্য নিউজ মিনিটে এই হার সবচেয়ে কম, সেখানে ৪৫ শতাংশ অসংরক্ষিত শ্রেণির। নিউজ লন্ড্রিতে ৪৯ শতাংশ কর্মী জেনারেল ক্যাটেগরির। অন্যদিকে নিউজ লন্ড্রি হিন্দির ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা ৬০ শতাংশ।
সমীক্ষা বলছে, সংবাদপত্র, নিউজ চ্যানেল, ওয়েব পোর্টালের তুলনায় দেশের ম্যাগাজিনগুলোতে ওবিসি প্রতিনিধিত্বের হার বেশি। তবে অন্যান্য ক্ষেত্রের মতোই ম্যাগাজিনেও এসসি বা এসটির প্রতিনিধিত্ব শূন্য।
Comments are closed.