বাবার অকাল মৃত্যুর পর ঘুরে ঘুরেও মেলেনি সরকারি চাকরি, ১৯ বছরের চেষ্টায় আইএএস, বিস্ময়কর উত্তরণ এক স্কুল ড্রপ আউটের
সরকারি অফিসে ফাইল নড়ে না। বহুশ্রুত এই অভিযোগ। কিন্তু সরকারি অফিসের এই চিরাচরিত মানসিকতার বদলের জন্য কী করা হয়েছে? স্বাধীনতার এত বছর পরেও এই প্রশ্নের উত্তর নেই দেশের কাণ্ডারীদের। এবার এই ছবি বদলেই উদ্যোগী হলেন তামিলনাড়ুর এক আইএএস অফিসার, কে এলামবাহাবত। তাঁর উত্থানের কাহিনীও কম বিস্ময়কর নয়। আর সেই কাহিনীর সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে এলামবাহাবতের অবিশ্বাস্য উত্তরণের সত্য ঘটনা। ১৯ বছর ধরে এক স্কুল ড্রপ আউটের অসম লড়াইয়ের গল্প।
১৯৮২ সালে তামিলনাড়ুর থাঞ্জাভুর জেলার এক ছোট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এলামবাহাবত। বাবা ছিলেন সরকারি চাকুরে, মা কৃষক। আর পাঁচটা সাধারণ ছেলেমেয়ের মতোই ছেলেবেলা কেটেছে এলামবাহাবতের। দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় আচমকা মৃত্যু হয় তাঁর বাবার। অকূল পাথারে পড়ে পরিবার। আর্থিক অনটনের কারণে মাঝপথেই স্কুল ছাড়তে বাধ্য হন কে এলামবাহাবত। সরকারি আধিকারিকদের কাছে বাবার চাকরি পাওয়ার দরখাস্ত করেও লাভ হয়নি কিছুই। সরকারি অফিসে ঘুরতে ঘুরতে জুতোর শুকতলা খয়ে যাওয়ার জোগাড়, কিন্তু চাকরি মিলল না। হতাশ এলামবাহাবত বুঝেছিলেন এভাবে কর্মসংস্কৃতি বদলাবে না। সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে আরও মানবিক হতে হবে সরকারি কার্যালয়গুলোকে। সেদিনই তরুণ এলামবাহাবত ঠিক করে ফেলেছিলেন, সরকারি চাকরি করে এই অবস্থা বদলাতে হবে। শুরু হল এক নতুন লড়াইয়ের।
বাবার আচমকা মৃত্যুতে মাঝ পথেই পড়াশোনা ছাড়তে হয়েছিল। অথচ স্নাতক না হলে বসতেই পারবেন না কোনও সর্বভারতীয় চাকরির পরীক্ষায়। তাই প্রথমে ডিসট্যান্স এডুকেশনের মাধ্যমে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতক। তারপর শুরু আইএএস হওয়ার তোড়জোড়। আইএএসের জন্য প্রস্তুতি নিতে কোনও সাহায্য পাননি তিনি। যা করেছেন স্রেফ ইচ্ছাশক্তির জোরে। গ্রামের কাছাকাছি ছিল একটি সাধারণ গ্রন্থাগার। সেখানেই ইউপিএসসি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি শুরু করেন এলামবাহাবত। কিন্তু বুঝলেন, প্রথাগত প্রস্তুতি ছাড়া এই পরীক্ষায় উতরোনো অসম্ভব। কিন্তু টাকা নেই। তাহলে প্রস্তুতি নিতে গাইডেন্স সেন্টারে ভর্তি হবেন কী করে? মুশকিল আসান হল, তামিলনাড়ু সরকারের সিভিল সার্ভিস কোচিংয়ে। সেখানকার পরীক্ষায় পাস করার পর খানিকটা আশার আলো দেখতে পেলেন এলামবাহাবত। যদিও প্রথাগত প্রস্তুতির পর একাধিকবার চেষ্টা করেও ইউপিএসসি পরীক্ষায় পাশ করতে পারেননি এলামবাহাবত। তবে পাশ করলেন তামিলনাড়ুর সরকারি চাকরির পরীক্ষায়, যা নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারেননি এলামবাহাবত। ফের চলতে থাকে প্রস্তুতি। শেষ পর্যন্ত ২০১৫ সালে ইউপিএসসি পরীক্ষায় পাশ করেন তিনি। সারা দেশের মধ্যে পান ১১৭ তম স্থান। বর্তমানে তামিলনাড়ু ক্যাডারের এই আইএএস অফিসার ভেলোর জেলায় কর্মরত।
১৯ বছর ধরে যে লড়াই লড়ে গেলেন দাঁতে দাঁত চেপে, আজ সেই লড়াই শেষ হয়েছে। যে সরকারি অফিসের গয়ংগচ্ছ মনোভাবে সেদিন চাকরি জোটেনি এলামবাহাবতের, আজ তিনিই সরকারি অফিসের অন্যতম নীতি নির্ধারক। এলামবাহাবত বলছেন, সরকারি অফিসের সামনে লাইন দিয়ে রোজ যে মানুষগুলো দাঁড়িয়ে থাকেন, তাঁদের দুর্দশা, অসহায়তা আমি বুঝতে পারি। একদিন আমাকেও এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে হোত লাইনে। সেদিনই ঠিক করেছিলাম, এই মানুষগুলোর দুর্দশা দূর করার কাজই করব। দীর্ঘদিন লড়াই করে এই জায়গায় পৌঁছতে পেরে ওই মানুষগুলোকেই ধন্যবাদ দিতে চাই।
Comments are closed.