‘পার্টিতে আমার মতো পরিণতি একদিন তোমারও হবে, চলো সিপিএম ছেড়ে সৈফুদ্দিনের পিডিএসে যোগ দিই,’ বললেন সুভাষদা।
আগের পর্বেই লিখেছি, ২০০১ সালের শুরুতে সৈফুদ্দিন চৌধুরী, সমীর পুততুণ্ডরা পার্টি ছেড়ে নতুন দল তৈরি করার কয়েক দিন পরেই একদিন সুভাষ চক্রবর্তী তাঁর মহাকরণের ঘরে আমাকে ডাকলেন। আমি যেতেই আমাকে নিয়ে নিজের অ্যান্টি চেম্বারে ঢুকে গেলেন। প্রথমে আমি কিছুটা হতচকিত হই, সুভাষদা কী এমন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করবেন! তারপর অ্যান্টি চেম্বারের দরজা বন্ধ করে উনি কথা শুরু করলেন। প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কিছু খাবে?’ বললাম, ‘না টিফিন করে এসেছি।’ সেদিন দীর্ঘক্ষণ আলোচনা চলেছিল। সুভাষদার মূল কথা ছিল, তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে পার্টি প্রাপ্য সম্মান থেকে তাঁকে বঞ্চিত করে চলেছে। সারা রাজ্যের মানুষের কাছে সীমাহীন ভালোবাসা পেলেও, সেই ভালোবাসাই তাঁর প্রতি অনেক নেতার ঈর্ষার কারণ। সে জন্য পার্টিতে তাঁকে বহু বছর ধরে রাজ্য কমিটির সদস্য হিসেবে থেকে যেতে হয়েছে। দলে এর থেকে উচ্চ কোনও পদেই তাঁর জায়গা হয়নি। অথচ পরে দলে এসে, রাজ্য কমিটিতে তাঁর পরে স্থান পেয়েও অনেকে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। যার একমাত্র মাপকাঠি নেতৃত্বের পছন্দ-অপছন্দ। তাঁর যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাঁকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে কেন? কীসের জন্য? এক বুক অভিমান নিয়ে এই প্রশ্ন করেছিলেন তিনি। এরূপ অনেক কথাই সেদিন অকপটে তিনি আমাকে বলেন। এর মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথাও ছিল। শিষ্টাচার বজায় রাখার জন্য সব কথা লিখতে না পারলেও, যে কথা না লিখলেই নয়, তা হল, তিনি সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কেও সেদিন বেশ কিছু বিস্ফোরক মন্তব্য করেছিলেন। বিশেষ করে মুখ্যমন্ত্রীর অতীতে সরকারের দায়িত্ব ছেড়ে চলে যাওয়া, আবার ফিরে আসা এবং চলে যাওয়ার সময় সরকার সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য সরকার ও পার্টিকে কোন জায়গায় দাঁড় করিয়েছিল। সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত মুখ্যমন্ত্রী যে দফতরের দায়িত্ব পালন করতেন, সেখানকার কাজকর্ম, বিশেষ করে পুলিশ-প্রশাসনের ব্যর্থতা, যার কারণে রাজ্যে বিরোধীদের সন্ত্রাসের এই ঘটনা, সব কিছুই সুভাষদার কথায় উঠে আসে সেদিন।
তিনি আরও বলেন, ‘আমি সত্যি কথা সোজা করে বলি, তথাকথিত নেতৃত্বের পছন্দসই কথা বলতে পারি না বলে মানুষ আমাকে পছন্দ করলেও, সেই সব তথাকথিত পদাধিকারী নেতা আমাকে পছন্দ করেন না।’ বললেন, ‘সুদূর নয়, অদূর ভবিষ্যতেই সরকার ও পার্টি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, শুধু দেখে যাও।’ আমি তাঁর এসব কথা শুনে হতবাক হয়ে পড়েছিলাম। সুভাষদা এও বললেন, ‘অনেকদিন রাজনীতি করছি, বয়সে আমি তোমার থেকে অনেকটাই বড়। পার্টিতে তোমার কাজের জন্য আগামী দিনে কী মূল্যায়ন হয়, ভবিষ্যতে তুমি তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারবে।’ সুভাষদা আজ বেঁচে আর নেই। সেদিনের তাঁর প্রত্যেকটি কথা আজও আমার কানে বাজে। মনের মধ্যে বারেবারে ফিরে আসে। তারপরও অনেকবার উনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আমাকে বলেছেন, ‘পার্টি তোমার প্রতি সুবিচার করল না। আমি রাজ্য সম্পাদককেও একথা বলেছি।’
তখন আমি সুভাষদাকে বলেছিলাম, ‘আমাকে এসব বলছেন! আমি তো মেদিনীপুর জেলা কমিটির সাধারণ সদস্য মাত্র। রাজ্য কমিটিতেও নেই।’ তখন অনিলদার মতো তিনিও একই কথা বলেন, ‘কোন কমিটির সদস্য বড় কথা নয়। তুমি গোটা রাজ্যের মানুষের ভালোবাসা অর্জন করতে পেরেছো। মানুষ তোমাকে চেয়েছে এটাই বড় কথা।’ তিনি যে কথাগুলো আমাকে বলেছিলেন, তার অনেক কথাই তিনি দলের অনেক নেতাকেও জানিয়েছিলেন বলে সুভাষদা আমাকে বলেন। ফলে দলের তখন যাঁরা নেতা ছিলেন, এখনও যাঁরা আছেন, তাঁদের প্রত্যেকেরই অবগতির মধ্যে সেগুলি থাকা উচিত। যাই হোক সব কথা বলে আমি সৌজন্যের সীমা লঙ্ঘন করতে চাই না। শেষে যে মোদ্দা কথা তিনি আমাকে বলেন, ‘সুশান্ত আমি বলে রাখছি, আমার মতো পরিণতি তোমারও হবে। মানুষের এই ভালোবাসার কারণে তোমারও দলের মধ্যে আগামী দিনে এগিয়ে যাওয়ার পথে জটিলতা সৃষ্টি করবে। তুমি মিলিয়ে নিও।’ এরপর তাঁর প্রস্তাব ছিল, ‘সৈফুদ্দিন, সমীররা (সমীর পুততুণ্ড) ক’দিন আগেই নতুন দল গড়েছে, তুমি জানো। চলো তুমি, আমি পার্টির এই স্রোত থেকে বেরিয়ে গিয়ে নতুন দলে যোগ দিই। আশা করি আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে আমরা বুঝিয়ে দিতে পারব বাংলার মানুষ কী চায়।’
সব কথা শোনার পর আমি সুভাষদাকে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলি, ‘আপনার সব কথা, ঘটনা, যুক্তির সঙ্গে আমি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সহমত হলেও, এই একটি জায়গায় আমি অপারগ। যেদিন এই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম, সেদিন যাঁরা আমায় হাত ধরে এই রাজনীতিতে নিয়ে এসেছিলেন, কমরেড মোতিলাল মন্ডল আর কমরেড শুভেন্দু মন্ডল (দু’জনেই অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলা কমিটির সদস্য ছিলেন) তাঁদের দেওয়া শিক্ষা থেকেই গ্রহণ করেছিলাম যে, আদর্শের জন্য সব ত্যাগ করা যায়, কিন্তু কোনও কিছুর জন্যই আদর্শকে ত্যাগ করা যায় না। তাই আমার পক্ষে সিপিআইএম ছেড়ে অন্য কোনও পার্টিতে যাওয়া সম্ভবপর নয়।’ আরও বলেছিলাম, ‘আমার রাজনীতিতে আসা কোনও মামা, কাকা, দাদা বা আত্মীয়ের হাত ধরে নয়, বরং বলা যায় এর একেবারেই বিপরীতে। যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি। বাবা ছিল পুরানো কংগ্রেসি মানুষ। জ্যাঠামশাই ছিলেন বামপন্থী ঘরানার মানুষ। ছোটবেলায় যখন স্কুল-কলেজে পড়ি, বাবা-জ্যাঠামশাইয়ের মধ্যে রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে তর্ক-বিবাদ হতে দেখেছি। তাতে অবশ্য পরিবার ভাঙেনি। কিন্তু এই তর্ক বিবাদ থেকে কংগ্রেসি নাকি বামপন্থী, কোন রাজনীতি ভালো তা জানার আগ্রহ জন্মায়। নিজের বুদ্ধি দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণে বামপন্থী আদর্শই সাধারণ মানুষের জন্য ভালো বলে মনে হয়েছে। কলেজে পরীক্ষা শেষ করে বাড়ি ফেরার পরেই, বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হই এবং স্থানীয় নেতৃত্বের ইচ্ছায় ১৯৭৮ এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে দাঁড়িয়ে জয়লাভ করি। আমার এই ভোটে দাঁড়ানোর পেছনে জ্যাঠামশাইয়ের ভূমিকাও ছিল। এর কয়েক মাসের মধ্যেই পার্টির সাধারণ কর্মী হিসাবে দলের লোকাল কমিটির কেন্দ্রে পাকাপাকিভাবে চলে যাই। গোটা রাজ্যে মানুষের যে ভালোবাসা পেয়েছি তা এই রাজনীতির জন্যই। এই দল ত্যাগ করলে মানুষ আমায় ভুল বুঝবেন। তাই এই দল ত্যাগ করে অন্য কোনও রাজনৈতিক দলে যোগদান করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’ তখন সুভাষদা বলেন, ‘ঠিক আছে, আজই তোমায় কোনও সিদ্ধান্ত নিতে হবে না। তুমি সাত দিন সময় নিয়ে ভাবো, চিন্তা-ভাবনা করো। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।’
২০০১ এর প্রথমে, যেদিন সুভাষদার সঙ্গে আমার এই কথাবার্তা হয়, তার কয়েক বছর পর ঝাড়গ্রামের জঙ্গলমহলে শালকু সোরেনকে মাওবাদীরা তথা জনসাধারণের কমিটি খুন করে। এরপর দিনের পর দিন খোলা আকাশের নীচে মাও সন্ত্রাসের কারণে তাঁর মৃতদেহ পড়ে থাকে। তার সৎকার করা সম্ভব হচ্ছিল না। রাজ্য প্রশাসন এক কথায় ছিল নীরব দর্শক। সমস্ত সংবাদমাধ্যমে খবর হচ্ছে দিনের পর দিন। শালকু সোরেনের অপরাধ ছিল, সে মাওবাদী ও জনসাধারণের কমিটির কথা মেনে লাল ঝাণ্ডা ত্যাগ করেনি। তাই তাঁকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়। শালকুর বৃদ্ধা মায়ের কাতর আবেদনেও তাঁর সন্তানের জীবন রক্ষা পায়নি। নৃশংসভাবে খুন করে তাঁর মৃতদেহ ফেলে রেখে এলাকায় ফতোয়া জারি করা হয়, ‘কেউ যেন শালকুর মৃতদেহের সৎকার করার চেষ্টা না করে। তাহলে তারও পরিণতি হবে শালকুর মতো।’ এর মূল উদ্দেশ্য হল মানুষের মধ্যে আতঙ্ককে এমনভাবে গেঁথে দিতে হবে যেন কেউ জনসাধারণের কমিটির বা মাওবাদীদের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে।
২০০৯ সালে শালকু সোরেনের ঘটনা যখন ঘটে সেই সময় জয়কৃষ্ণ ঘোষ মারফত একদিন জ্যোতি বসু আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি সাথে সাথেই জ্যোতিবাবুর দেওয়া সময়ে ওনার বাড়িতে হাজির হই। সেদিন আমার স্ত্রীও আমার সঙ্গে জ্যোতি বসুর বাড়িতে যেতে চাওয়ায় তাঁকেও সঙ্গে করে নিয়ে গেলাম। আমার কাছে জঙ্গলমহলের সব কথা শোনার পর যে ভয়ঙ্কর উক্তি উনি সেদিন করেছিলেন, তা প্রকাশ করা ঠিক হবে না। যেহেতু জ্যোতি বসু ও জয়কৃষ্ণদা দুজনেই প্রয়াত হয়েছেন, তাই সে কথা বললে তা শিষ্টাচার বিরোধী হবে। শিষ্টাচার বজায় রেখে যেটুকু বলা যায় তা হল, জ্যোতিবাবুর মুখে রাজ্য প্রশাসন নিয়ে কয়েক বছর আগে সুভাষদার বলা কথারই প্রতিধ্বনী শুনলাম। তিনি বললেন, ‘তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হল……।’ সে কথা প্রকাশ করার মতো নয়।
জ্যোতি বসুর বাড়ি থেকে বের হওয়ার পূর্বে তাঁর সামনেই আমার স্ত্রীকে বলি, ‘তুমি বাইরে এসব কথা বোলো না।’ তখন সে আমাকে থামিয়ে দিয়ে জ্যোতি বসুকে আরও কিছু কথা বলে, যা শুনে তিনি যা মন্তব্য করেন তাও কম মারাত্মক নয়। আমার স্ত্রী জ্যোতি বসুকে বলে, ‘কিছুদিন পূর্বে, যেদিন জনসাধারণের কমিটির দাবি মেনে রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসন জঙ্গলমহলের সব পুলিশ ক্যাম্প বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তখন মেদিনীপুর জেলা পার্টি এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে কোনওভাবে যুক্ত ছিল না। পুলিশ অফিসাররা দ্রুত আনুষ্ঠানিকভাবে পুলিশ ক্যাম্প বন্ধ করে দিয়ে জনসাধারণের কমিটি তথা মাও নেতাদের হাতে ক্যাম্পের চাবি তুলে দিচ্ছিল। যেদিন রামগড়ের পুলিশ ক্যাম্পের চাবি মাওবাদী নেতা সিধু সোরেনের হাতে তুলে দিচ্ছিলেন একজন উচ্চ-পদাধিকারী পুলিশ অফিসার, তা ফলাও করে সংবাদমাধ্যমে প্রচার করা হয়। সেদিনই পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা কমিটির সভা চলছিল। (আমার স্ত্রীও তৎকালীন জেলা কমিটির সদস্য ছিলেন।) সেই সময় আমি জেলা কমিটির মিটিংয়েই বলি, ‘ভয়ঙ্কর এই সন্ত্রাসের সময় প্রতিদিন এলাকায় আদিবাসী ক্ষেত-মজুর থেকে সাধারণ গরিব কৃষক, শিক্ষক-ছাত্র, যুব-মহিলা সাধারণ মানুষের রক্ত ঝরছে, তখন পুলিশ ক্যাম্পের চাবি মাওবাদীদের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত যারা নিতে পারে তাঁরা আসলে সাম্রাজ্যবাদীদের এজেন্ট নয়তো? পার্টিকে একদিন না একদিন এর মূল্যায়ন করতেই হবে।’ জেলা কমিটির সভায় আমিও সেদিন উপস্থিত ছিলাম। আমার স্ত্রীর এই কথা শুনে সভায় উপস্থিত সকলে হতবাক হয়ে যায়। একজনও জেলা কমিটির সদস্য একথার প্রতিবাদ তো করেনইনি, বরং বলা যায় এই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন। সভার শেষের দিকে এই প্রশ্নের সরাসরি কোনও উত্তর না দিলেও, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার তৎকালীন সম্পাদক পুলিশ ক্যাম্প বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত যে ঠিক না, তা ঘুরিয়ে বলার চেষ্টা করেন। আমার স্ত্রীর মুখে এই পুরো ঘটনা শোনার পর জ্যোতি বসু আমাদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘জানি না, আর কতদিন এসব দেখতে হবে!’ এরপর আমরা ওনার বাড়ি থেকে চলে আসি। একথা জেলাজুড়ে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে যায়।
আবার ফিরে আসি সুভাষদার কথা প্রসঙ্গে। কদিন পরে আমি সুভাষদাকে বললাম, ‘আমি আপনাকে যা বলেছিলাম, সেই সিদ্ধান্তেই দৃঢ় আছি। আমার নতুন কোনও আর ভাবনা নেই।’ পরে দেখলাম সুভাষদাও দলে থেকে গেলেন। এই থেকে যাওয়ার পেছনে কমরেড জ্যোতি বসুর ভূমিকা, কমরেড অনিল বিশ্বাসের প্রচেষ্টা এবং সুভাষদার স্ত্রী রমলাদির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এসবের মধ্যেই ২০০১-এর নির্বাচন এসে যায়। নির্বাচনে প্রচারের ব্যস্ততায় রাজ্যজুড়ে দৌড়ে বেড়াই। তৎকালীন বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রবল চাপ, কেন্দ্রীয় প্রশাসনসহ নির্বাচন কমিশনের চূড়ান্ত তৎপরতার মধ্যেই বিধানসভা নির্বাচনে অনুষ্ঠিত হয়।
পরবর্তী সময়ের একটি ঘটনার কথাও এই ফাঁকে উল্লেখ করে রাখি। এর প্রায় ৬-৭ বছর পরে কোয়েম্বাটুর পার্টি কংগ্রেসে আমি আর সুভাষদা একই জায়গায় বসেছিলাম। সম্মেলনের শেষ পর্যায়ে নতুন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের নামের প্রস্তাব পেশ করা হয়। সেই প্রস্তাবে এমন কিছু নাম ছিল, যা শুনে প্রস্তাব পেশের সাথে সাথেই উনি বলেন, ‘এই হল পার্টির মূল্যায়ন।’ একবুক অভিমান নিয়ে তখনই তিনি ক্ষোভের সঙ্গে সম্মেলনস্থল ছেড়ে কলকাতা ফেরার জন্য রওনা হয়ে যান। তার কিছুদিনের মধ্যেই তিনি দূরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হন। পার্টি কংগ্রেসের পর যখন রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী গঠন হয়, সেই তালিকায় অবশ্য সুভাষ চক্রবর্তী জায়গা পান। একে সুভাষদা আমার কাছে ‘পার্টির থেকে পাওয়া সান্তনা পুরস্কার’ হিসাবে ব্যাখ্যা করেন। প্রথমেই বলেছি, শালীনতা বজায় রেখে যতটা উল্লেখ করা যায় করলাম। এটাও হয়তো বর্তমানে আলোচনার বিষয়বস্তু হবে। কিন্তু পার্টির সর্বস্তরের কর্মী-সমর্থকদের এসব কথা জানাও উচিত। তা না হলে এসব কথা তাদের কাছে পৌঁছবে না। সুভাষদার এই কথা নিয়ে আমি তৎকালীন রাজ্য সম্পাদককে বলেছিলাম। তিনি সব শোনার পর বললেন, ‘সুভাষদার ক্ষোভ-অভিমান অসংগত নয়, কথা বলব। দেখি কী করা যায়।’
২০০১ এর বিধানসভা নির্বাচনকে ঘিরে রাজ্যের রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যেকার বিন্যাস বদলাতে শুরু করে। এনডিএ জোটের শরিক দল তৃণমূল কংগ্রেস কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ছেড়ে বেরিয়ে আসে। বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেয়। রেল দফতরকে সামনে রেখে রাজ্যে সাফল্য পাওয়ার যে পরিকল্পনা তৎকালীন রেলমন্ত্রী তথা রাজ্যের বিরোধী নেত্রী করেছিলেন, তাও থমকে যায়। অন্যদিকে, সন্ত্রাসের মধ্যে দিয়ে বিরোধীরা যে আধিপত্য বিস্তার করেছিল, গণ-প্রতিরোধ গড়ে ওঠায় সেই সব এলাকার পরিস্থিতিরও পরিবর্তন হতে থাকে। একেবারে সটান বিজেপির সঙ্গ ত্যাগ করে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধায় তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে দ্রুত বাংলার মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করাতেও ঘাটতি থেকে যায়। এই সব কারণের জন্যই ক্ষমতা দখলের বিরোধীদের স্বপ্ন অধরা থেকে যায়।
‘ক্ষমতার পালাবদল হবেই’, বিরোধীদের এই ঘোষণা ব্যর্থ করে ফল ঘোষণার দিন রাজ্যের মানুষ বামেদের পক্ষেই রায় দেয়। যদিও সিপিএম একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। বামেরা ২৯৪ এর মধ্যে ১৯৯ আসন পেয়ে ষষ্ঠবারের জন্য সরকার গঠন করে। সিপিএম পেয়েছিল ১৪৫ আসন। যেদিন রাজভবনের লনে মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ হয়, তা আমার জীবনে নতুন অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ।
শুরু হয় ষষ্ঠ বামফ্রন্ট সরকারের পথ চলা। আমার জন্য বরাদ্দ হয়, শ্রম দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব। আমি এতে হতবাক হয়ে যাই। জীবনে কখনওই ট্রেড ইউনিয়নের কাজকর্ম বা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। তাহলে আমাকে এরূপ একটি দায়িত্ব দেওয়া হল কেন? দফতরের দায়িত্ব বন্টনের মূল ইচ্ছা মন্ত্রিসভায় যিনি মুখ্য তাঁর উপরেই নির্ভরশীল। এটাই প্রথা। এই দফতরের ক্যাবিনেট মন্ত্রী হন প্রয়াত শ্রদ্ধেয় কমরেড মহম্মদ আমিন। আমাকে খুব স্নেহ করতেন। এই দফতরের যে দুটি বিভাগে আমাকে কাজ করতে বলা হয়, তা হল কর্ম বিনিয়োগ কেন্দ্র এবং ইএসআই নথিভুক্ত শ্রমিকদের চিকিৎসা সংক্রান্ত বিভাগ। এই দুটি বিভাগেই সেরকম কাজ কিছু ছিল না। ২০০১ এর পূর্বেই সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তে কর্ম বিনিয়োগ কেন্দ্রগুলি প্রায় কর্মহীন হয়ে গিয়েছিল। আর, ইএসআই-এর চিকিৎসা ব্যবস্থা, কেন্দ্রের নিয়ম বিধি দ্বারাই মূলত পরিচালিত। এ নিয়ে আমি যখন আমিন সাহেবকে বলি, তখন উনি বলেন, ‘মন্ত্রিসভার দায়িত্বের থেকেও, রাজনীতির যে দায়িত্ব তুমি রাজ্যজুড়ে পালন করছ, তাই তোমায় আরও বেশি করে পালন করতে হবে। সাথে মন্ত্রিসভার যেটুকু কাজ, সেটুকুই করবে।’ এর চেয়ে বেশি কিছু উনি আমায় বললেন না। চুপ করে গেলেন। তাই যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমিন সাহেবকে আমার দফতর নিয়ে জানতে চেয়েছিলাম, সেটা পূরণ হল না। এর কিছু দিনের মধ্যে জয়কৃষ্ণ ঘোষ মারফত সময় নিয়ে একদিন আমি সল্টলেকের ইন্দিরা ভবনে জ্যোতিবাবুর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। (চলবে)