১৯৮৯ সালে বামেদের মতোই এবার রাজ্যে তৃণমূল পেতে পারে ৩৭ টা সিট, ওপিনিয়ন পোলের নামে মানুষকে বিভ্রান্ত করা ঠিক নয়
আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে কেন্দ্রে কে ক্ষমতায় আসতে চলেছে তাই নিয়ে আলোচনা চলছে। আলোচনা স্বাভাবিক। মানুষের মনে রাজনীতি নিয়ে উৎসাহ থাকবেই। গণমাধ্যমেও চলবে আলোচনা। সে পত্রিকার পাতাতেই হোক, কিংবা টেলিভিশনের পর্দায়। আলোচনা কখনও উচ্চগ্রামে উঠবে কখনও বা বিতর্ক হবে যথাযথ। কিন্তু সব কিছুর মধ্যেই থাকা উচিত একটা বস্তু এবং তা হল, যেটা বলতে চাইছি সেটা সত্যি মনে করি কিনা। আমি দেখাতেই পারি অনেক কিছু, কিন্তু সেটা আমার বিশ্বাসের সাথে যদি সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয় তবে তা আশ্চর্যজনক। সেটা যেমন ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে সত্য, তেমনই সামাজিক পরিসরে। ব্যক্তিগত পরিসরে হয়ত আমি কারুর প্রতি অতি আবেগপূর্ণ ব্যবহার করলাম, যা অন্তরগতভাবে একেবারেই সত্য নয়। হয়ত কিছুটা সত্য, বাকিটা নয়। কিন্তু যে আচরণের বহিঃপ্রকাশ আমি ঘটালাম তার মধ্যে সততার লেশমাত্র রইল না। পলিটিকাল সায়েন্স চর্চায় আচরণবাদ একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে কোনও ব্যবহারকেই বুঝতে হবে মূল্যনিরপেক্ষভাবে। অর্থাৎ, কোনটা ভাল কোনটাই বা মন্দ সেই হিসেবে নয়। যা রয়েছে তাকেই সবার সামনে তুলে ধরে আলোচনা করতে হবে। আপন মনের মাধুরি মিশিয়ে নয়।
এবিষয়ে সচেতন থাকতে হবে যে সামাজিক পরিসরে আমি যা দিচ্ছি, তা একান্তই আমার প্রাপ্ত তথ্য বা অর্জিত ধারণা এবং তার মধ্যে কোনও মিথ্যা নেই। ভুল থাকতে পারে। অবশ্যই পারে। ভুল থাকাটা একান্তই স্বাভাবিক একটি ঘটনা। কিন্তু জেনে-বুঝে মিথ্যার আসর সাজানো অন্যায়। সেই অন্যায় কাজটিই আমাদের গণমাধ্যম অনেকদিন ধরে করে চলেছে, যা অতি দুঃখবহ ঘটনা। এটি হল ওপিনিওন পোল। অর্থাৎ, ভোট প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই ভোটের সম্ভাব্য ফলাফল সম্পর্কে একটি আভাস দেওয়া। এই কাজ পৃথিবী জুড়েই হয়। এর মধ্যে কোনও অন্যায় নেই। মানুষের রাজনৈতিক আচরণ বোঝার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হচ্ছে ভোটের আগের এই সমীক্ষাগুলি। কিন্তু এখানে কতগুলি কথা বলার আছে। পশ্চিম ইউরোপ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সমাজ বাস্তবতা অনেকটা একইরকম। অর্থাৎ, একই ভাষা, সংস্কৃতি, মোটামুটি একই ধরনের জীবনবোধ এই দেশগুলিতে রাজনৈতিক মতামতের ক্ষেত্রেও ধরা পড়ে। বৈচিত্র্য নিশ্চয়ই আছে, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাদা-কালো বিভাজন এবং সেই বিভাজন প্রসূত রাজনৈতিক মতামতের হেরফের অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া আছে পেশাগত কিছু বৈচিত্র্য। বিভিন্ন পেশার দাবি-দাওয়াগুলি বিভিন্ন হতে পারে। কিন্তু ভোটদানের ক্ষেত্রে মোটের উপর একটা সামঞ্জস্য প্রতীয়মান হয়। এই জন্য দলীয় বিভাজনও খুব ক্ষীণ। মাঝে-সাঝে কোনও বড় নেতার আবির্ভাব হয় মঞ্চে, কিন্তু তিনি যা বলেন তার খুব বেশি দার্শনিক চাহিদা থাকে না। মানুষ দেখতে ভালবাসেন, কীভাবে তাঁদের মতামতগুলি দলীয় বক্তব্যে প্রতিফলিত হচ্ছে। ইস্যুগুলি খুব কাছাকাছি। প্রায় গায়ে গায়ে লাগানো। কখনও-সখনও তা বৃহৎ মাত্রা নিলেও আপাতভাবে স্থিতিশীল। দলগুলির মধ্যেও আদর্শগত বিভাজন খুব বৃহৎ মাত্রায় দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। ট্রাম্প যা বলেন তা শুনে বিবমিষা জাগলেও অন্তিমত রাজনৈতিক মত হিসেবে যেটা উঠে আসে তার সাথে মার্কিন সমাজের মূল চাহিদার বিশেষ কোনও ফারাক নেই। তাই প্রাক নির্বাচনী সমীক্ষায় যা পাওয়া যায় তার অনেকটাই ঠিক হওয়ার সম্ভবনা থাকে।
কিন্তু আমাদের দেশে এই ধরনের সমীক্ষাগুলির মূল সমস্যা হল, যে sample size নিয়ে কাজ করা হয় তা অতি ক্ষুদ্র। পদ্ধতিতে কোনও সমস্যা নেই। তা পুরোপুরি পাশ্চাত্য সমাজবিদ্যা নির্ভর। রাশিবিজ্ঞানের হিসেবেও হয়ত কোনও ভুল থাকে না সচরাচর। কিন্তু তার উপর নির্ভর করে পাশ্চাত্য ধাঁচের সমীকরণ টানতে গেলে ভুল হবেই। এখানেই আসল গল্পটা লুকিয়ে আছে।
ভারত এমনই একটি রাষ্ট্র যেখানে বৈচিত্র্য অনেক। সামাজিক, অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য তো আছেই, এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে রাজনৈতিক মতামতের বৈপরীত্য। ক্ষণে ক্ষণে মতামত এমনইভাবে পাল্টে যাচ্ছে যে তার সাথে সামাল দেওয়া কার্যত অসম্ভব হয়ে ওঠে। কোনও বিষয়েই মতামতের বিশেষ কোনও ধারাবাহিকতা নেই। সেই জন্য মতামতকে প্রভাবিত করার একটা খুব প্রচ্ছন্ন চেষ্টা থাকে। তাতেও কোনও অসুবিধা হত না যদি স্বীকার করে নেওয়া যায় যে এই প্রচেষ্টা আন্তরিক। রাশিবিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে এমন কাজ করা কখনই সমীচীন নয়। ২০১৪ তে আমরা জানতাম যে ইউপিএ হারবে। কিন্তু যে বিপুলতার সাথে সেটা ঘটে তা একান্তই আমাদের জনমত নির্মাণকারীদের হাতযশ। এর পশ্চাতে হয়ত বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু তার থেকেও বড় কথা হল এই যে, আমরা কীভাবে এই সমস্যার মোকাবিলা করতে পারি?
আমরা একথা কখনই বলব না যে জনমত সমীক্ষা উঠে যাক। সমাজে চাহিদা থাকলে অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী তার জোগানও থাকবে। মুক্ত গনতন্ত্রের সেটাই নিয়ম হওয়া উচিত। কিন্তু সেখানে সীমাবদ্ধতার কথাও বলে নেওয়া ভাল। নয়ত পুরোটাই মিথ্যা অভিসন্ধিমুলক বলে মনে হতে পারে। যেমন কখনই দেখানো উচিত নয় যে এই প্রার্থী জিতে গেছেন। ওই প্রার্থী হেরে গেছেন। একটি প্রবণতা দেখানো উচিত। সেক্ষেত্রে মানুষের অকারণ বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ থাকে না। আর একান্তই যদি প্রভাবিত করতে হয় সেটা সরাসরি হোক। আলোচনায় স্পষ্ট দেগে দেওয়া হোক সমস্ত মাত্রা। বলে বুঝিয়ে দেওয়া হোক যে, কোন দল বা নেতার হয়ে কথা বলা হচ্ছে। একটি সর্বভারতীয় চ্যানেলের সর্বাধিনায়ক যেমনটা করে থাকেন। তাঁর বক্তব্য বা আচার আচরণ এক বিন্দু সমর্থন না করেও বলা যায় যে মানুষটা সৎ। কোনও বিজ্ঞান নির্ভর ভণ্ডামি অন্তত করছেন না বা লোকের চোখে ধুলো দিতেও চেষ্টা নেই কোনও। একেবারে সরাসরি মানুষের দরবারে। আপনার ভাল লাগুক বা মন্দ, তাতে থোড়াই কেয়ার।
কিন্তু আবার অনেকের সেই ধাত নেই। সাহসও নেই। মনে মনে চাইছেন পাকিস্তান এর সাথে একটা যুদ্ধ ফুদ্ধ হোক, কিন্তু কইতে কথা বাধে। বিজ্ঞানের আশ্রয় নিয়ে নিরন্তর সতীপনা চালিয়ে যেতে হবে। চাইছেন পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি আসুক। অর্জুন সিংহ ব্যারাকপুরে ৫৫% শতাংশ ভোট পান বা মুনমুন সেন ১০%, কিন্তু সেটা বুক ফুলিয়ে ঘোষণা করার সাহস নেই। অতএব ছলচাতুরির আশ্রয় নিতে হবে পাবলিককে বিভ্রান্ত করতে।
আমাদের ওসব কোনও দায় নেই। সরাসরি বলি, বাম-কংগ্রেস জোট হলে আসন্ন নির্বাচনে এ রাজ্যে বিজেপির ভোট কমতো। বাম ও কংগ্রেস উভয় পক্ষই উপকৃত হত। ভবিষ্যতেও। কিন্তু তা যখন হল না, বিরোধী পরিসর অনেকটাই নেবে বিজেপি। বামপন্থী বা কংগ্রেস সমর্থনও জায়গায় জায়গায় ক্রিয়াশীল থাকবে। কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। দু’একটি আসনে কাজে লাগতে পারে। বিজেপি টানবে বেশি। শাসক দল শুধু তার নিজের ভোট ধরে রাখতে পারলে, আসন্ন নির্বাচনে এ রাজ্যে তৃণমূল সেই ফলটাই করতে যাচ্ছে, যা ১৯৮৯ তে বামপন্থীরা করেছিলেন। ওই বছর তৎকালীন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান কমরেড সরোজ মুখোপাধ্যায় স্লোগান তুলেছিলেন, ৪২ আসনে ৪২ টাই পাবে বামপন্থীরা। অনেকটা আজকের তৃণমূল নেত্রীর মতোই। সেবছর এরাজ্যে বামেদের ৪২ এ ৪২ হয়নি, তবে ৩৭ টা সিট হয়েছিল।
আবার বলছি, দীর্ঘদিন ভোটের রাজনীতি দেখে এটা অনুমান মাত্র। কোনওভাবেই বিজ্ঞানের ধুয়ো তুলে জনমতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা নয়।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Comments are closed.