দৃষ্টান্ত স্থাপন কাস্ত্রোর কিউবার, ১৩০ দিন লড়াইয়ের পর প্রথমবার স্থানীয় সংক্রমণ থেকে মুক্ত দেশ, বিচে বিচে উৎসবের মেজাজ

আমি আপনাদের বারবার ঘরে থাকতে বলেছি। কিন্তু আমি জানি আজ হয়ত অনেকেই বিচমুখো হবেন। রবিবার মাস্ক নামিয়ে হাসতে হাসতে এমনই বলেন ফ্রান্সিসকো ডুরান। কিউবার জনস্বাস্থ্য মন্ত্রকের এপিডেমিওলজি বিভাগের প্রধানের এই কথাগুলোই করোনা ত্রাসে থরহরিকম্প বিশ্বে রুপোলি রেখা হিসেবে দেখা হচ্ছে। কিন্তু কেন? এর উত্তর লুকিয়ে কিউবার ১৩০ দিনের মরণপণ লড়াইয়ের মধ্যে। যার ফলশ্রুতি, গত ১৩০ দিন ধরে কাস্ত্রোর দেশ কিউবায় স্থানীয় স্তরে করোনা সংক্রমণের খোঁজ মেলেনি। জানাচ্ছে আন্তর্জাতিক সংবাদসংস্থা রয়টার্স।

ভারতের বাম শাসিত কেরলে সম্প্রতি গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হয়েছে দাবি করে সংশ্লিষ্ট রাজ্য প্রশাসন। স্বভাবতই সে কথা মানতে নারাজ আইসিএমআর। এর আগে দিল্লি কিংবা মুম্বইয়ের ধারাভিতে গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হয়েছে বলে দাবি উঠেছিল। সেই দাবিও খারিজ করেছিল আইসিএমআর। তাদের বক্তব্য, কোনও একটি নির্দিষ্ট জায়গায় সংক্রমণের উৎস খুঁজে না পাওয়া গেলেই তাকে গোষ্ঠী সংক্রমণের গোত্রে ফেলা যায় না। বরং ভারতের মতো বিশাল এবং প্রবল বৈষম্যের দেশে একে স্থানীয় সংক্রমণ বলা যেতে পারে মাত্র।

এই স্থানীয় সংক্রমণ নিয়েই এতদিন চিন্তিত ছিল বামপন্থী কিউবাও। স্থানীয় সংক্রমণ রুখতে নেওয়া হয়েছিল একগুচ্ছ পদক্ষেপ। এমনিতেই কিউবায় স্বাস্থ্য পরিষেবা সরকার নিয়ন্ত্রিত, ফলে সাধারণ মানুষ বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা পান। কিন্তু বিশ্বজোড়া অতিমারির গ্রাসে এসে পড়েছিল আমেরিকার প্রতিবেশি কিউবাও। সেখানে এখনও পর্যন্ত ২৫০০ সংক্রমণের খবর পাওয়া গিয়েছে, মৃত্যু হয়েছে ৮৭ জনের। এই পরিস্থিতিতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সংক্রমণের খোঁজ, সংক্রমিতকে আইসোলেট করা এবং লাগাতার কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের উপর ভর করেই ১৩০ দিনের মধ্যে দেশে স্থানীয় সংক্রমণ রুখে দিল ফিদেল কাস্ত্রোর দেশ। যা গোটা বিশ্বে মডেল হিসেবে তুলে ধরা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা বলে মনে করা হচ্ছে।

পৃথিবীর আর পাঁচটা দেশের মতোই করোনাভাইরাস হানা দিয়েছিল বামপন্থী কিউবাতেও। একটা সময় তা ক্রমেই বেড়ে উঠছিল। এই পরিস্থিতিতে নাওয়া খাওয়া ভুলে স্বাস্থ্য বিভাগ ঝাঁপিয়ে পড়ে মোকাবিলায়। সঙ্গত করতে থাকে বাকি বিভাগগুলো। গোটা অপারেশনের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেন ফ্রান্সিসকো ডুরান। মাস্কে মুখ ঢেকে প্রতিদিন টিভিতে দেশের করোনা পরিস্থিতি জানিয়েছেন। সদা গম্ভীর সেই মানুষটিই রবিবার নাটকীয়ভাবে মাস্ক খুলে ফেলেন। জাতীয় টেলিভিশনের লাইভ অনুষ্ঠানে মুচকি হাসিও ফোটে তাঁর মুখে। বলেন, জানি, আজ অনেকেই বিচে যাবেন, পার্টি করবেন, পানহার চলবে রাত অবধি। কিন্তু হাসি মস্করার মধ্যেও ভুলে যাওয়া যাবে না মাস্কের ব্যবহার এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা। কারণ আজকের হাসির পিছনে তারই অবদান। তাই ভবিষ্যতেও হাসতে চাইলে, নিয়ম মানুন।

১১.২ মিলিয়ন জনসংখ্যার কিউবা এবং আশেপাশের অন্যান্য ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের দেশগুলোতে ক্রমশ কমছে সংক্রমণের হার। গত একমাসে কিউবাতে সংক্রমণ পাওয়া গিয়েছে একমাত্র রাজধানী হাভানায়। এই পরিস্থিতিতে দেশে স্থানীয় স্তরে সংক্রমণ ছড়ানো বন্ধ হওয়ার কথা ঘোষণা করা হল। দেশে চলছে স্বাভাবিকতা ফেরানোর তৃতীয় পর্যায়ের আনলক পর্ব। এই পর্বে স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়া হবে। এমন সময় স্থানীয় সংক্রমণ বন্ধ হওয়ার খবরে স্বভাবতই উচ্ছ্বসিত বামপন্থী কিউবার বাসিন্দারা।

করোনা ত্রাসে যখন কাঁপছে গোটা দুনিয়া, তখন কিউবার করোনা মোকাবিলার নীল নকশাকে সর্বোচ্চ নম্বর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, যেভাবে পরিকল্পনামাফিক কিউবা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তা বাহবার যোগ্য।

যদিও এই গোলার্ধেরই আরেক দেশ আমেরিকা, এখনও করোনা সামলাতে হাবুডুবু খাচ্ছে। জার্মান সংবাদসংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কিউবার সাফল্য দেখে আমেরিকা কী শিখছে, সেটাই এখন দেখার।

Comments are closed.