মর্মান্তিক: লকডাউনে ঘরে ফিরতে ১০০ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে বাড়ির ১১ কিমি আগে থেমে গেল আদিবাসী কিশোরীর জীবন

আর মাত্র ১১ কিলোমিটার। অপেক্ষা করছে কুঁয়োর ঠান্ডা জল আর তালপাতার পাখার বাতাস। এদিকে তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ। ১২ বছরের জামালো মাডকম পাখির চোখ করেছিল বাড়িতে পৌঁছনোকে। কিন্তু কে জানত, বন-জঙ্গল-নগর-জনপদ পেরিয়ে ১০০ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে, বাড়ি থেকে মাত্র ১১ কিলোমিটার দূরে চিরকালের মতো হাল ছেড়ে দেবে ছোট্ট জামালো? বাড়িতে ফিরবে তাঁর নিথর দেহ!

বাবা আন্দোরাম আর মা সুকামতি মাডকমের একমাত্র সন্তান জামালো। বনের উপর নির্ভরশীল ছত্তিসগঢ়ের বিজাপুর জেলার আদেদের এই আদিবাসী পরিবার। কিন্তু বন থেকে আর কতই বা রোজগার, তাই মাস দুয়েক আগে বছর বারোর জামালোকে বাবা-মা পাঠিয়েছিলেন পাশের রাজ্য তেলঙ্গানায়। সেখানে প্রতিবছরই লঙ্কা চাষে মজুরি খাটতে ছত্তিসগঢ় থেকে এভাবেই দলে দলে আদিবাসীরা যান। কাজ চলছিল ভালোই। আচমকা করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এবং তা রুখতে প্রধানমন্ত্রীর লকডাউন ঘোষণা। জীবনটা উল্টোপাল্টা হয়ে যায় ছোট্ট জামালোর। বন্ধ হয়ে যায় লঙ্কার খেতে কাজ। কার্যত তালা পড়ে ছোট্ট পেটেও। তবুও কোনওরকমে লকডাউনের প্রথম পর্ব কাটে। কিন্তু লকডাউন শেষ হয় না। পেট তা মানবে কেন?

গ্রামেরই আরও কয়েকজন মহিলার সঙ্গে তেলঙ্গানার পেরুরু গ্রামে লঙ্কা খেতে কাজে গিয়েছিল জামালো। লকডাউনের মেয়াদ বাড়ছে শুনে তাঁরা সবাই ছত্তিসগঢ়ের বাড়িতে ফেরার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু বন্ধ বাস-ট্রেন, পৌঁছবেন কী করে? শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়, হেঁটে রওনা দেবেন।

সন্তান শোকে পাথর আন্দোরাম বলছেন, ১৬ তারিখ জানতে পারি ওঁরা বাড়ি ফেরার জন্য রওনা হয়ে গিয়েছে। তারপর ১৮ তারিখ খবর পাই জামালোর চলে যাওয়ার।

ঠিক কী হয়েছিল?

জানা গিয়েছে, তেলঙ্গানার পেরুরু গ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরত্বের ছত্তিসগঢ় রওনা হয়েছিল জামালোদের ১৩ জনের দল। তার মধ্যে ছিল জামালোর মতোই আরও ৩ শিশু এবং ৮ মহিলা। প্রত্যেকেরই বাড়ি ছত্তিসগঢ়ের বিজাপুর।

তারপর টানা ৩ দিন ধরে পায়ে হেঁটে ছত্তিসগঢ় সীমায় পৌঁছয় দলটি। ইতিমধ্যেই ক্লান্ত, অবসন্ন জামালো আর পারছিল না। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ, শরীরে হাজার বছরের ক্লান্তি। ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরত্বের মধ্যে জামালো পেরিয়ে এসেছে শহর-বন-জঙ্গল-ফাঁকা মাঠ। কিন্তু নিজের রাজ্যের সীমায় এসে পড়ে যায় জামালো। অথচ অবস্থা ভাবুন, দলের একজনের কাছে ছিল মোবাইল ফোন। যা ইতিমধ্যেই ব্যাটারি ফুরিয়ে ডেড। ফলে জামালোর বাড়িতেও জানাতে পারেননি কেউ।

জানা গিয়েছে ১৮ এপ্রিল সকাল ৮ টা নাগাদ মৃত্যু হয় ১২ বছরের জামালোর। শেষপর্যন্ত ছত্তিসগঢ়ের বিজাপুর জেলায় পৌঁছে ভাণ্ডারপাল গ্রামে একজনের কাছ থেকে মোবাইল ফোন চেয়ে জামালোর বাড়িতে সংবাদ দেওয়া হয়। এদিকে ভাণ্ডারপালের গ্রামবাসীরা বহিরাগতদের দেখে পুলিশে খবর দেন। পুলিশ আসে। কিন্তু ততক্ষণে নিথর জামালোর দেহ কাঁধে নিয়ে আরও খানিকটা এগিয়ে গিয়েছে দল। প্রশাসন কার্যত তাড়া করে ধরে ফেলে দলটিকে। জামালোর দেহ পাঠানো হয় মর্গে। দলের বাকিদের পাঠানো হয় কোয়ারেন্টিনে।

১৯ তারিখ সন্ধেয় সন্তানের দেহ নিতে পৌঁছন বাবা আন্দোরাম আর মা সুকামতি মাডকম। ডাক্তাররা বলছেন, শরীরে মারাত্মক জলের অভাব এবং সামগ্রিক ক্লান্তি সইতে পারেনি জামালোর ছোট্ট শরীর। টানা ৩ দিন হাঁটতে হয়েছে যে!

ছত্তিসগঢ় সরকার জামালোর মা-বাবাকে ১ লক্ষ টাকা আর্থিক সহায়তা করেছে। মৃত্যুর ঠিক পরের দিন জামালোর নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট আসে, নেগেটিভ। আর এভাবেই দেশজুড়ে করোনা হাহাকারের মধ্যে বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছেও বেঘোরে চলে গেল ছোট্ট জামালো।

Comments are closed.