বাবা-মায়ের দেওয়া নাম ‘আর নয়’ থেকে সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বিরুদ্ধে হার না মানা লড়াই অন্ধ্রের তরুণীর
অন্ধ্র প্রদেশের শ্রীহরিকোটা থেকে তামিলনাড়ুর চেন্নাইয়ের দূরত্ব মেরেকেটে ১০০ কিলোমিটার। কিন্তু চন্দ্র অভিযানের চূড়ান্ত প্রস্তুতিতে লেগে থাকা শ্রীহরিকোটা থেকে চেন্নাইয়ের নিকটবর্তী নারায়ণাপুরম গ্রামে পুরুষতান্ত্রিকতার বিষবাস্পে দগ্ধ এক নারীর জীবন সংগ্রাম যেন দুরত্বটাকে বাড়িয়ে কয়েক আলোকবর্ষ করে দেয়। ভারত যখন চাঁদে পাড়ি দেওয়ার স্বপ্নে মশগুল, ঠিক তখন তার চেয়ে মাত্র একশো কিলোমিটার দুরত্বে, এক নারীর সমাজের বিরুদ্ধে হার না মানা লড়াই কোনও অংশেই চন্দ্র অভিযানের চেয়ে কম নয়। সদ্য কলেজ পাশ করা তরুণী ভেন্দামের লড়াইটা আসলে নিজের সঙ্গে, আরও স্পষ্ট করে বললে নিজের নামের সঙ্গে। যে লড়াই জিতে জাপানের পথে পাড়ি দিচ্ছেন ভেন্দাম।
তামিলনাড়ুর তিরুভাল্লুর জেলার তিরুথানির কাছে নারায়ণাপুরম গ্রামে দিনমজুর জি অশোকন এবং স্ত্রী গৌরির কোলে আসে ফুটফুটে কন্যা সন্তান। নাম দেওয়া হয় ভেন্দাম, স্থানীয় ভাষায় যার অর্থ ‘সমাপ্তি’ কিংবা ‘আর নয়’। এই নামকরণের পিছনেই লুকিয়ে যুগ যুগান্ত ধরে চলে আসা পুরুষতান্ত্রিকতার কুপ্রভাব। পুত্র সন্তানের আকাঙ্খায় থাকেন দেশের সিংহভাগ মা-বাবা। কেননা কন্যা সন্তানের জন্ম হওয়া মানে মা-বাবার উপর জীবনভর বোঝা চাপিয়ে দেওয়া। তাই পুত্র সন্তানের আকাঙ্খায় জল ঢেলে তৃতীয় সন্তানও কন্যা হওয়ার পর সমাজের মাতব্বরেরা অশোকন এবং গৌরিকে বলেছিলেন, এ মেয়ের নাম রাখা হোক ভেন্দাম।
অর্থাৎ, জন্ম থেকেই নামের মধ্যেই এক অদ্ভুত বৈষম্য। একেবারে ছেলেবেলায় নিজের নামের অর্থ বুঝতে পারেনি ভেন্দাম। কিন্তু একবার অর্থ পরিষ্কার হওয়ার পর থেকে এক নতুন লড়াইয়ে নামে সে। মেয়ে হিসেবে জন্ম নিয়ে সে কি সত্যিই মা-বাবা, সমাজের কাছে বোঝা হয়ে উঠেছে? দোষ কি কেবল তাঁর মেয়ে হয়ে জন্মানোর? চরম দারিদ্রের পাশাপাশি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল সেই ছোটবেলা থেকেই। ধৈর্ষ ধরে বাবা-মাকে বুঝিয়েছিল, ছেলে আর মেয়েতে সত্যি কোনও ফারাক নেই। দরকার কেবল সমান সুযোগের। বাবা সামান্য দিন মজুর এবং মা গৌরি রাজ্য সরকারের ১০০ দিনের কর্মী। দারিদ্রকে উপেক্ষা করে সীমিত ক্ষমতা দিয়ে স্বভাব মেধাবী মেয়েকে পড়িয়েছেন তাঁরা। দশম শ্রেণির পর ভেন্দাম ঠিক করে ইঞ্জিনিয়র হবে সে। যেমন কথা, তেমন কাজ। পরীক্ষা দিয়ে চেন্নাই ইন্সস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে সুযোগ পায় ভেন্দাম। লক্ষ্য একটাই, পড়া শেষে চাকরি পেয়ে নিজের নাম-দুর্নাম ঘোচাতেই হবে।
ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পড়ার পাশাপাশি ভেন্দাম শিখে ফেলে জাপানি ভাষা। অতঃপর ক্যাম্পাস ইন্টারভিউয়ে একটি জাপানি বহুজাতিক তাঁকে নির্বাচন করে। চাকরির একেবারে শুরুতেই ভেন্দাম পাবে ভারতীয় মুদ্রায় বছরে ২২ লক্ষ টাকা। নারায়ণাপুরমের দিন আনি দিন খাইয়ের সংসারে এখন আনন্দের তুফান, দারিদ্র এখন অতীত। শুধুমাত্র মেয়ে হয়ে জন্মানোর অপরাধে সমাজ যাঁর নামে বৈষম্য ভরে দিয়েছিল, আজ সেই অপমানকে পাল্টা জবাব দেওয়ার পালা। সমান সুযোগ পেলে যে ছেলে-মেয়েতে ভেদাভেদ নেই, তা নারায়ণাপুরম জেনেছে ভেন্দামের লড়াই থেকে। আর ভেন্দাম কী বলছে? আমার লড়াই অর্ধেক জেতা হয়েছে। পরবর্তী লক্ষ্য, যে চরম অপমানজনক নামের বোঝা তাঁকে বইতে হয়েছে এতদিন, সেই নামকে তিনি চিরতরে বিদায় দিতে চায় সে। জাপান পৌঁছব আমি আর আমার নতুন নাম, জানাচ্ছে ভেন্দাম। নাম তো মুছল, কিন্তু সমাজ বদলাবে কি?
Comments are closed.