কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদীই বিজেপির প্রধান মুখ, তা গত লোকসভা ভোটে দ্বিতীয়বারের জন্য প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের চেয়েও অনেক বেশি আসনে জিতে বিজেপি একাই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দিল্লির মসনদ দখল করেছে। যে যাই বলুক, এর মূল কৃতিত্ব অবশ্যই নরেন্দ্র মোদীর। কিন্তু দিল্লি বিধানসভা ভোটের ফলাফল বুঝিয়ে দিল, কেন্দ্রের প্রধান মুখ মোদী কিন্তু রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে প্রধান হতে পারছেন না। রাজনৈতিক মহল মনে করছে, এর থেকে আর একটা বিষয়ও পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে, মোদীর ভোট মানেই বিজেপির ভোট নয়।
গত লোকসভা ভোটের আগে-পরে অনুষ্ঠিত বেশ কয়েকটি রাজ্য বিধানসভার ভোটের ফলাফলের দিকে নজর দিলেই বিষয়টি বোধগম্য হবে। ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটে বিজেপি একাই ৩০০ রও বেশি আসন নিয়ে কেন্দ্রের ক্ষমতায় আসে। তার কয়েক মাস আগেই মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান এবং ছত্তিশগড়ের বিধানসভা ভোটে হেরে গিয়েছে বিজেপি। আবার লোকসভা ভোটের পর হরিয়ানায় কোনও রকমে একে তাকে নিয়ে বিজেপি সরকার গড়েছে। মহারাষ্ট্রে শিবসেনার সঙ্গে জোট করেই ভোটে লড়াই করেছে। কিন্তু ভোটের ফল প্রকাশ হওয়ার পরেই শিবসেনার সঙ্গে বিজেপির দীর্ঘদিনের পুরনো জোট ভেঙ্গে যায়। বিজেপি নানা ভাবে শিবসেনা থেকে সদস্য ভাঙ্গিয়ে এনে সরকার গড়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তাও সফল হয়নি। কংগ্রেস এবং এনসিপির সঙ্গে জোট করে শিবসেনা মহারাষ্ট্রে সরকার করেছে। ঝাড়খণ্ডেও সম্প্রতি বিধানসভা ভোটে গোহারা হেরেছে বিজেপি। সরকার গড়েছে জেএমএম, কংগ্রেস, আরজেডি জোট। আর মঙ্গলবার দেখা গেল, দিল্লিতে আপের ঝাড়ুর দাপটে একেবারে সাফ হয়ে গিয়েছে বিজেপি। কোনও রকমে আটটি আসন এসেছে তাদের ঝুলিতে। ২০১৫ সালে তারা পেয়েছিল মাত্র তিনটি আসন। আর কংগ্রেসের কথা তো যত কম বলা যায়, ততই ভালো। তারা গত বিধানসভা ভোটে একটি আসনও পায়নি। এ বারও তাদের খালি হাতেই ফিরতে হয়েছে।
ভোটের পরিসংখ্যান দেখে বোঝা যাচ্ছে, গত এক-দেড় বছরে যে ক’টি রাজ্যে বিধানসভা ভোট হয়েছে, তার সব ক’টিতেই লোকসভা ভোটের তুলনায় বিধানসভা ভোটে বিজেপির ভোট শতাংশও অনেক কমে গিয়েছে। এ বার পরিসংখ্যানের দিকে তাকানো যাক। ২০১৮ সালে ছত্তিশগড়ের বিধানসভা ভোটে মোট ৯০ টি আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছে মাত্র ১৫ টি। তারা পেয়েছিল ৩৩ শতাংশ ভোট। লোকসভা ভোটে মোট ১১ টি আসনের মধ্যে বিজেপি পায় ৯ টি । অথচ লোকসভায় তাদের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৫০.৭০ শতাংশ। মধ্যপ্রদেশে বিধানসভায় বিজেপি পায় ১০৯ টি আসন। তাদের ভোট ছিল ৪১ শতাংশ। সেখানে লোকসভা ভোটে ২৯ আসনের মধ্যে বিজেপি একাই ২৮ টি। লোকসভায় তাদের ভোট ছিল ৫৮ শতাংশ।
রাজস্থান বিধানসভার ভোটে বিজেপি পেয়েছিল ৭৩ টি আসন। প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ৩৮.৮ শতাংশ। আবার লোকসভায় ২৫ টি আসনের মধ্যে বিজেপি দখল করে ২৪ টি। লোকসভায় তারা পেয়েছিল ৫৮.৫ শতাংশ ভোট। হরিয়ানা বিধানসভায় বিজেপি ৪০ টি আসন পায়। কংগ্রেস পায় ৩১ টি। নির্দল, অন্য দল ভাঙ্গিয়ে কোনও মতে বিজেপি হরিয়ানায় সরকার গড়তে পেরেছে। তাদের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৩৬.৪৯ %। অথচ লোকসভা ভোটে ১০ টির মধ্যে ১০ টিই পায় বিজেপি। সেখানে তাদের ভোট ছিল ৫৮.০২ শতাংশ। মহারাষ্ট্র বিধানসভায় বিজেপি পায় ১০৫ টি আসন। তাদের ভোট ছিল ২৫.৭৫ শতাংশ। লোকসভা ভোটে তারা পায় ২৩ টি আসন। প্রাপ্ত ভোট ২৭.৫৯ %। সদ্য হয়ে যাওয়া ঝাড়খণ্ড বিধানসভায় বিজেপি পায় ২৫ টি আসন। ভোট পায় ৩৩.৩৭ শতাংশ। কিন্তু লোকসভায় ১৪ টির মধ্যে ১২ টিই যায় বিজেপির ঝুলিতে। আর তাদের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৫৫.২৯ শতাংশ।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি এই ট্রেন্ড চলতে থাকে, তা হলে আগামী দিনে যে সব রাজ্যে বিধানসভার ভোট রয়েছে, সেগুলিতেও বিজেপির ধাক্কা খাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। এ বছরই বিহারে ভোট রয়েছে। আগামী বছর ভোট পশ্চিমবঙ্গ, কেরল সহ কিছু রাজ্যে। বিজেপি অনেক দিন ধরেই পশ্চিমবঙ্গকে পাখির চোখ করে সংগঠন তৈরি করছে। বিশেষ করে লোকসভা ভোটে ১৮ টি আসন পেয়ে বিজেপি ধরেই নিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ তাদের হাতের মুঠোয় প্রায় এল বলে। দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ-সহ অন্য অনেক নেতাই বলছেন, বিধানসভা আর লোকসভার ভোট এক নয়। দিল্লির ভোটের কোনও প্রভাব এই রাজ্যের ভোটে পড়বে না। তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি বলছেন, বিজেপির শেষ কলস ডুববে ২০২১ সালে এই বাংলায়। একুশেই ওদের বাংলা ছাড়া করা হবে। প্রশ্ন উঠেছে, দিল্লি এবং তার আগে হয়ে যাওয়া বিভিন্ন বিধানসভা ভোটের বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারবে কি বিজেপি?
Comments are closed.