ভয়াবহ জল সঙ্কটের মুখে দেশ, ১০ বছরের মধ্যে ৪০ শতাংশ মানুষ পাবেন না পরিশ্রুত পানীয় জল, আশঙ্কা নীতি আয়োগের
পরিবেশবিদরা অনেকদিন ধরেই আশঙ্কা প্রকাশ করছিলেন দেশে জলের সমস্যা নিয়ে। কিন্তু তাতে টনক নড়েনি রাজনৈতিক নেতাদের বা কোনও সরকারেরই। সারা দেশ যখন ভয়াবহ খরায় নাজেহাল, তখন এমনই জল সঙ্কটের এক ভয়াবহ আশঙ্কার কথা শোনাল খোদ নীতি আয়োগ।
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, ভারতের ইতিহাসে এমন ভয়াবহ জল সঙ্কট নজিরবিহীন। আর নীতি আয়োগ বলছে, ২০২০ সালের মধ্যে দেশের ২১ টি শহরের মাটির তলার জল ভাণ্ডার সম্পূর্ণ শুকিয়ে যাবে। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ মানুষ পরিশ্রুত পানীয় জল পাবেন না। নীতি আয়োগ আরও জানিয়েছে, পরিশ্রুত পানীয় জলের সূচকে ১২২ টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১২০।
উপরের পরিসংখ্যান থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট, অদূর ভবিষ্যতে এক ভয়ঙ্কর সঙ্কটের মুখে পড়তে চলেছে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র। প্রসঙ্গত, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ যদি কখনও বেঁধে যায়, তার মূল কারণ হবে জল, এমনটাই গত কয়েক বছর ধরে বারবার বলে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। ইতিমধ্যেই ভারতে পানীয় জলের সমস্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। চেন্নাই সহ বিস্তীর্ণ তামিলনাড়ুতে ভূগর্ভস্থ জলের সঞ্চয় কমেছে লক্ষ্যণীয়ভাবে। মহারাষ্ট্র, গুজরাত, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্র প্রদেশ, রাজস্থান, মধ্য প্রদেশ, ছত্তিসগঢ়ের বিস্তীর্ণ অংশে এক ফোঁটা জল নেই। নদী-নালা-খাল-বিল শুকিয়ে কাঠ। একমাত্র ভরসা সরকারি ট্যাঙ্কার। রাত থাকতে কলসি নিয়ে সেই সরকারি ট্যাঙ্কারের লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছে গোটা মারাঠাওয়াড়া, গুজরাত, অন্ধ্র, ছত্তিসগঢ়ের সাধারণ মানুষ। পরিস্থিতি এমনই যে মারাঠাওয়াড়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে কেউ কেউ ট্যাঙ্কারওয়াড়া বলেও চিহ্নিত করছেন। তাহলে চাষবাসের কী হবে? ট্যাঙ্কারের জলে তেষ্টা মেটে না, চাষ হবে কীভাবে? বলছেন, জলের কলসি নিয়ে সরকারি ট্যাঙ্কারের লাইনে দাঁড়ানো মানুষেরা।
কিন্তু এমন ভয়াবহ জল সঙ্কটের কারণ কী? পরিবেশবিদরা জানাচ্ছেন, অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ন এবং যথেচ্ছ সবুজ নিধনের যুগলবন্দিতেই প্রকৃতির এমন রুদ্ররূপ। অবৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পাম্পের সাহায্যে নির্বিচারে ভূগর্ভস্থ জল তুলে ফেলা হয়েছে। পরিবেশবিদদের অভিযোগ, এই অবস্থার কথা হয়তো ধরাই পড়ত না, যদি এবছরও বর্ষা স্বাভাবিক নিয়মেই শুরু হতো। হাওয়া অফিসের রিপোর্ট বলছে, জুলাইয়ে মাঝামাঝি পর্যন্ত দেশে বৃষ্টির ঘাটতি প্রায় ৪৪ শতাংশ। এর ফলে নদী-নালা-খাল-বিলের জল শুকিয়ে গিয়েছে। জল নেই জলাধারগুলোতেও। অনিয়ন্ত্রিত পাম্প সেট ব্যবহারের ফলে ভূগর্ভস্থ জলও তলানিতে। কয়েকটি জায়গায় জল উঠছেই না। ফলে জলের চিরাচরিত উৎস থেকে প্রয়োজনীয় জল সংগ্রহ করতে পারছেন না কৃষকরা। জলের অভাবে মাঠেই মারা যাচ্ছে খেতের ফসল। অন্যান্যবার খরা পরিস্থিতি তৈরি হলেও এমন ভয়াবহ আকার ধারণ করে না। কিন্তু এবার একদিকে যেমন তীব্র তাপ প্রবাহ, অন্যদিকে বর্ষার বৃষ্টির বিরাট ঘাটতি। এই দুয়ের ফলে প্রাণ ওষ্ঠাগত ভারতের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের।
পরিস্থিতি কীভাবে খারাপ হচ্ছে, তা বুঝতে একটি উদাহরণ যথেষ্ট। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা কিংবা গঙ্গার যাত্রাপথ এলাকায় জলের অভাব কখনওই মাত্রাছাড়া হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এবার ভয়াবহ জল সঙ্কটে ধুঁকছে একদা শস্য শ্যামলা বিহারও। অউরঙ্গাবাদ, গয়া, নওয়াদা জেলায় জলের হাহাকার এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে বিহার সরকার ১৪৪ ধারা জারি করতে বাধ্য হয়েছে, যাতে সাধারণ মানুষ কুঁয়ো কিংবা জলাশয়ের পাশে ভিড় না করেন। ডাক্তাররা জানাচ্ছেন, প্রবল গরমের কারণে মাত্রাছাড়া আকার ধারণ করেছে ডিহাইড্রেশন কিংবা জলবাহিত পেটের রোগ। হিট স্ট্রোকে মৃত্যুর ঘটনাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রোজ। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে, ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সঙ্কট নিয়ে কি সরকার আদৌ চিন্তিত?
Comments are closed.