২০১৯ লোকসভা ভোটের রেজাল্টের পর একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, সিপিএমের সমালোচনা করে কোনও খবর আর প্রকাশ করব না। তার কারণ যাঁরা বোঝার নিশ্চই বুঝবেন। আর সেই কারণটা বোঝানোর জন্য অনেকেই সাধারণত যে প্রবাদটি ব্যবহার করেন, তা হরেকৃষ্ণ কোঙারের পার্টির জন্য প্রয়োগ করতে ভালো লাগে না। কিন্তু ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের ঢাকে কাঠি পড়া যেখানে স্রেফ করোনার জন্য আটকে রয়েছে, সেখানে দাঁড়িয়ে একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়ে আজ এই লেখা। মনে হল, আমাদের পোর্টাল যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন, ইতিহাসের দলিলে এই ঘটনাটার উল্লেখ থাকা দরকার।
পড়ুন: কেন ইস্তফা দিলেন আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়? পুলিশকে কী চিঠি দিয়েছিলেন তিনি?
মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসেও জ্যোতি বসু শ্রমিক, কর্মচারীদের উদ্দেশে বারবারই বলতেন, আন্দোলনের অধিকার আপনারা ছাড়বেন না। এমনকী তাঁর পুত্র চন্দন বসুর ব্যবসা করা বা শিল্পপতি হয়ে ওঠাতেও রাজ্যের শ্রমিক-কর্মচারীর একটা বড় অংশ জ্যোতি বসুকে নিজের লোক বলেই মনে করেতেন। কিন্তু এই শ্রমিক-কর্মচারীর মধ্যে সিপিএমের ভিতটাই নড়বড়ে হয়ে পড়ল একুশ শতকের শুরু থেকে। নির্দিষ্টভাবে বললে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর। ২০০১ সালে মুখ্যমন্ত্রী হয়েই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কর্মচারীদের উদ্দেশে বার্তা দিলেন, ‘ডু ইট নাউ’। মুখ্যমন্ত্রীর এই কথা নিয়ে সিপিএমের ভাষায় তখনও পর্যন্ত ‘বুর্জোয়া’ সংবাদপত্র ঢাকঢোল নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়লেও, রাজ্যের শ্রমিক-কর্মচারী এর আসল মানে বুঝলেন আরও কিছুদিন বাদে। যখন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বললেন, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমি এমন একটা দল করি, যারা বনধ ডাকে’। সিপিএমের শ্রেণি চরিত্রের বদলের একটা ষোল কলা পূর্ণ হল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের এই মন্তব্যে। যদিও এই মন্তব্যের জন্য সিপিএমের তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাস পার্টির গঠনতন্ত্র মেনে বুদ্ধদেববাবুকে সেন্সর করেন, কিন্তু ততদিনে রাজ্যের হাজার-লক্ষ বাম-অতি বাম-বাম মনোভাবাপন্ন শ্রমিক, কর্মচারী বুঝে গিয়েছেন, জামবনি থেকে তালডাংরার সমবায় নির্বাচনে তাদের জয়ের খবর দলীয় মুখপত্র গণশক্তি পত্রিকার ভেতরের পাতায় ঠাঁই পাবে। আর প্রথম পাতায় উঠে আসবে প্রেসিডেন্সি কলেজের (তখনও বিশ্ববিদ্যালয় হয়নি) ছাত্র সংসদের ভোটে এসএফআইয়ের জেতার খবর। শ্রমিক-কৃষক নয়, ছাত্র-যুবই অগ্রাধিকার! সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম তো এরও পরের ব্যাপার।
লাল আবির মাখা ঝকঝকে ছেলে-মেয়েগুলোর ছবি গণশক্তির প্রথম পাতায় ছাপা হওয়ার মধ্যে কোনও অসুবিধে ছিল না। কিন্তু আস্তে-আস্তে কলকাতা এবং দুই ২৪ পরগনার নেতাদের দখলে চলে যাওয়া ৩১ আলিমুদ্দিন স্ট্রিট তখন খেয়াল করেও দেখেনি, ঘামে ভেজা জামা, ভাঙা চোয়াল, সরু কবজিতে ঢলঢল করতে থাকা এইচএমটি ঘড়ি পরা শ্রমিক-কর্মচারী কত দূরে সরে যাচ্ছেন প্রতিদিন। মুজফফর আহমেদ ভবন ফিরে দেখেনি, প্রেসিডেন্সির ছেলে-মেয়েদের গড় শ্রেণি চরিত্র এবং এই উদার অর্থনীতির যুগে কালচিনির চা বাগান থেকে খেজুরির ইঁটভাটার শ্রমিকের শ্রেণি চরিত্র এক নয়। বুদ্ধদেববাবু তখন মগ্ন এই ভাবনায়, প্রেসিডেন্সিকে উৎকর্ষ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
তো এই প্রেসিডেন্সিরই প্রাক্তনী এবং আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে যেদিন (৩০ মে) সূর্যকান্ত মিশ্র প্রথম ট্যুইট করলেন, তার ১০-১২ দিন আগেই করোনা এবং আমপানে বিধ্বস্ত বাংলায় এই সংবাদপত্র গোষ্ঠীতে কাজ হারান দুশোরও বেশি মানুষ। কাজ হারানো শ্রমিক-কর্মচারীদের নিয়ে একটা শব্দও উল্লেখ করলেন না সিপিএম রাজ্য সম্পাদক। আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকের ইস্তফার কারণ জানতে তিন দিনের ব্যবধানে তিনটি ট্যুইটে মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশ্ন করলেন সিপিএম রাজ্য সম্পাদক। চুপ থাকলেন শ্রমিক ছাঁটাই নিয়ে।
Comments are closed.