আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সমাজের বিভিন্ন দিকে তাঁদের সাফল্যকে তুলে ধরা হয় এই দিবসের মাধ্যমে। লিঙ্গ বৈষম্যকে দূরে সরিয়ে রেখে মহিলাদের সম্মানের দাবি আর কাজের উপযুক্ত স্বীকৃতি দেওয়ার লক্ষ্যে পালিত হচ্ছে এই বছরের আন্তর্জাতিক নারী দিবস। প্রতি বছরই আলাদা আলাদা থিমে পালিত হয় এই দিন। প্রথমবার ১৯৯৬ সালে থিমের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়েছিল। এই বছর করোনা আবহে নারী দিবসের থিম হচ্ছে Women in leadership: an equal future in a COVID-19 world অর্থাৎ মহিলাদের নেতৃত্বে কোভিড পরবর্তী জীবনে সাম্য। সারা বিশ্বের পাশাপাশি বাংলার নারীরাও আজ সমাদৃত। সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলার মহিলাদের কৃতিত্ব বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেছে। এই বিশেষ দিনে বাংলার কিছু নারীদের প্রতি রইল শ্রদ্ধা।
সুচিত্রা ভট্টাচার্য (সাহিত্যিক)
সুচিত্রা ভট্টাচার্য বিংশ শতাব্দীর একজন ভারতীয় বাঙালি সাহিত্যিক। নারীদের জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণা, অনুভূতি ফুটে উঠেছে তাঁর বিভিন্ন সাহিত্যে। সুচিত্রা ভট্টাচার্য তাঁর বইয়ের মাধ্যমে সমসাময়িক মধ্যবিত্ত শহুরে জীবনের টানাপোড়েন, পরিবর্তনশীল মূল্যবোধ আর নৈতিক অবক্ষয়কে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। বিহারের ভাগলপুরে জন্মগ্রহণ করার পর কলকাতার যোগমায়াদেবী কলেজ থেকে তিনি স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা লাভের সময় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন সুচিত্রা ভট্টাচার্য। সরকারী চাকরি পেয়েও ২০০৪ সালে পুরোপুরিভাবে লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন তিনি। প্রায় সাড়ে তিন দশকের দীর্ঘ সাহিত্যিক জীবনে সুচিত্রা ভট্টাচার্য অসংখ্য ছোটগল্প ও ২৪ টি উপন্যাস রচনা করেছেন। সাহিত্যে অবদানের জন্য এই বাঙালি নারী সাহিত্যিক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুবনমোহিনী মেডেল (২০০৪), কথা পুরস্কার (১৯৯৭), তারাশংকর পুরস্কার (২০০০), দ্বিজেন্দ্রলাল পুরস্কার (২০০১), শরৎ পুরস্কার, ভারত নির্মাণ পুরস্কার, সাহিত্য সেতু পুরস্কার, শৈলজানন্দ স্মৃতি পুরস্কার এর মতো নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
আশাপূর্ণা দেবী (সাহিত্যিক)
একজন ভারতীয় বাঙালি ঔপন্যাসিক, ছোটোগল্পকার ও শিশুসাহিত্যিক ছিলেন আশাপূর্ণা দেবী। বিংশ শতাব্দীর বাঙালি জীবন, বিশেষ করে সাধারণ মেয়েদের জীবনযাপন ও মনস্তত্ত্বের চিত্রই ছিল তাঁর রচনার মূল উপজীব্য। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন একজন সাধারণ গৃহবধূ। আশাপূর্ণা দেবী পাশ্চাত্য সাহিত্য ও দর্শন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞা ছিলেন। বাংলা ছাড়া দ্বিতীয় কোনও ভাষা সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ছিলনা। কিন্তু গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও পর্যবেক্ষণশক্তি দিয়ে বাংলা সাহিত্যে নিজের নাম উজ্জ্বল করেছিলেন তিনি। তাঁর প্রথম প্রতিশ্রুতি-সুবর্ণলতা-বকুলকথা উপন্যাসত্রয়ী বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রচনাগুলির অন্যতম। দেড় হাজার ছোটোগল্প ও আড়াইশো-র বেশি উপন্যাসের রচয়িতা আশাপূর্ণা সম্মানিত হয়েছিলেন জ্ঞানপীঠ পুরস্কার সহ দেশের একাধিক সাহিত্য পুরস্কারে। তিনি পেয়েছিলেন অসামরিক নাগরিক সম্মান ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি। পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ সম্মান রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। ভারত সরকার তাঁকে ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান সাহিত্য অকাদেমি ফেলোশিপে ভূষিত করে।
কাদম্বিনী গাঙ্গুলী
বাঙালি শুধু সাহিত্যচর্চাই করেনি, বিজ্ঞানচর্চাও করেছে মন দিয়ে। ছেলেদের মেয়েরাও সমানভাবে এগিয়ে এসেছে এই কাজে। বাংলা তথা ভারতের প্রথম মহিলা ডাক্তার ডাঃ কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়। কাদম্বিনী গাঙ্গুলী ব্রিটিশ ভারতের প্রথম দুই জন নারী স্নাতকের একজন এবং ইউরোপীয় চিকিৎসাশাস্ত্রে শিক্ষিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নারী চিকিৎসক। উনিশ শতকের শেষভাগে তিনি পাশ্চাত্য চিকিৎসায় ডিগ্রি অর্জন করেন এবং আনন্দীবাঈ জোশীর সাথে তিনিও হয়ে ওঠেন ভারতের প্রথমদিককার একজন নারী চিকিৎসক।
অসীমা চট্টোপাধ্যায়
ভারতীয় জৈব রসায়নবিদ ও উদ্ভিদ রসায়নবিদ ছিলেন অসীমা চ্যাটার্জি। ম্যালেরিয়া ও মৃগীরোগের ওষুধ তৈরীতে অসীমা চ্যাটার্জির অবদান অনস্বীকার্য।রসায়ন নিয়ে ১৯৪৪ সালে ডক্টরেট করেছেন অসীমা চ্যাটার্জি। তিনি বিজ্ঞানে দেশের প্রথম ডক্টরেট উপাধি পান। ১৯৬০ সালে অসীমা চ্যাটার্জি ভারতীয় জাতীয় বিজ্ঞান একাডেমির ফেলো হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রথম মহিলা হিসেবে রসায়ন বিজ্ঞানে শান্তি স্বরূপ ভটনাগর পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে তাকে পদ্মভূষণ প্রদান করা হয়।
বিভা চৌধুরী
১৯৪৯ সালে টাটা ইন্সটিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চে প্রথম মহিলা বিজ্ঞানী হিসেবে নিযুক্ত হন বিভা চৌধুরী। তিনি একজন ভারতীয় বাঙালি মহিলা পদার্থবিদ। তিনি কণা পদার্থবিজ্ঞান ও মহাজাগতিক রশ্মির উপর গবেষণা করেন। তাঁকে সম্মান জানাতে প্যারিসের ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন HD 86081 নক্ষত্রটির বিভা নাম দিয়েছে।
ঝুলন গোস্বামী
ক্রীড়া জগতেও নিজেদের নাম উজ্জ্বল করেছে বাঙালি মহিলারা। বাংলার গর্ব ঝুলন গোস্বামী ভারতের মহিলা ক্রিকেট দলের অলরাউন্ডার। ২০০৬-০৭ সালে ইংল্যান্ডে বিরুদ্ধে প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়ে ভারতীয় দলের হয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। ২০০৭ সালের বর্ষসেরা আইসিসি নারী খেলোয়াড় পুরস্কার লাভ করেন। ২০১১ সালের শ্রেষ্ঠ নারী ক্রিকেটার হিসেবে এম এ চিদাম্বরম ট্রফি জিতে নেন।
দীপা কর্মকার
এই জিমন্যাস্টকে বাংলা ‘সোনার মেয়ে’ নামে জানে। দীপার হাত ধরেই ভারতের জিমন্যাস্টিকে আন্তর্জাতিক সম্মান এসেছে বাংলায়। বাংলা, তথা গোটা দেশের বার বার মুখ উজ্জ্বল করেছেন দীপা। তিনি ২০১৪ সালে কমনওয়েলথ গেমসে প্রথম ভারতীয় জিমন্যাস্ট হিসাবে ব্রোঞ্জ পদক জেতেন। এর আগে জিমন্যাস্টিকসে কোন ভারতীয় আন্তর্জাতিক সম্মান পায়নি। তিনিই প্রথম ভারতীয় জিমন্যাস্ট, যে ৫২ বছর পর অলিম্পিক গেমসের জন্য নির্বাচিত হন।
Comments are closed.