কলকাতায় আজও শীতের দুপুর মানে চিড়িয়াখানা। আজও বাঙালি শীতের ছুটিতে চিড়িয়াখানামুখী হয়। বাঙালির এই চিড়িয়াখানার প্রতি প্রেম হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় থেকে বুদ্ধদেব গুহ। আর তাই তো তাঁরা লেখায় বারবার চিড়িয়াখানার কথা উল্লেখ করে গেছেন। প্রায় উনিশ হেক্টর এলাকা নিয়ে আজও উজ্জ্বল কলকাতা চিড়িয়াখানা | কিন্তু এই বিশাল আলিপুর চিড়িয়াখানার ইতিহাস কী ?
আলিপুর চিড়িয়াখানার ইতিহাস
১৮০০ সাল। ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি। সর্বপ্রথম তাঁর মাথায় এসেছিল একটি চিড়িয়াখানা (zoological garden) নির্মাণের কথা। যেমন ইচ্ছা তেমন কাজ, না তবে এক্ষেত্রে সেইরকম হয়নি। চিন্তা ভাবনার পর কেটে গিয়েছিল প্রায় ৭৫ টা বছর। ততদিন অবশ্য জীবিত ছিলেন না গভর্নর সাহেব। কিন্তু গভর্নর সাহেবের ইচ্ছাকে তো আর ফেলে রাখা যায় না! তাই বারাকপুরে তাঁর বাগান বাড়িতে একটা ছোটখাটো পশুশালা গড়ে তোলা হয়েছিল এবং সেটি অবশ্য “ইন্ডিয়ান ন্যাচারাল হিস্ট্রি প্রজেক্ট”-এর অংশ বিশেষ ছিল।
ইতিমধ্যে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা বছর, অন্যদিকে ইংল্যান্ডে বেশ কয়েকটি চিড়িয়াখানা স্থাপিত হয়েছে। তাই ব্রিটিশ সরকার দ্রুত একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে ফেলল। সেই পরিকল্পনা মতো ঠিক হল, ব্রিটিশ শাসনাধীন যে সমস্ত দেশ আছে, সেখানে পশুশালা বা চিড়িয়াখানা গড়ে তোলা হবে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, ব্রিটিশ সরকারের পরিকল্পনার আগেই ১৮৪১ সালের জুলাই মাসে “ক্যালকাটা জার্নাল অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রি” পত্রিকায় কলকাতায় একটি চিড়িয়াখানা স্থাপনের স্বপক্ষে যুক্তি দেওয়া হয়। আর এই যুক্তিতে শিলমোহর পড়েছিল ব্রিটিশ সরকারের চিন্তাধারার মাধ্যমে। এর প্রায় দুই দশক পরে ১৮৭৩ সালে তৎকালীন লেফটেনান্ট গভর্নর স্যার রিচার্ড টেম্পল কলকাতায় একটি চিড়িয়াখানা স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু এর পাশাপাশি ইতিহাস কিন্তু অন্য ঘটনারও সাক্ষী আছে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্র থেকে জানা যায়, জোসেফ বার্ট, যিনি কিনা সমসাময়িক সময়ে এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গলের সভাপতি হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন, তিনিই সর্বপ্রথম ১৮৬৭ সালে একটি চিড়িয়াখানা তৈরির প্রস্তাব দেন। কিন্তু জায়গার অভাবে সেই প্রস্তাব বাতিল করা হয়েছিল। এরপরে আবার ১৮৭৩ সাল নাগাদ কার্ল লুইস নামে এক ভদ্রলোক চিড়িয়াখানা গঠন করার প্রস্তাব ভারত সরকারকে দেন। কিন্তু জায়গার অভাবের কারণে দুটি প্রস্তাবই বাতিল করা হয়। কিন্তু যেহেতু ইংল্যান্ডের ব্রিটিশ সরকার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল, তাই চিড়িয়াখানা স্থাপন যথেষ্ট জরুরি হয়ে ওঠে। সর্বোপরি ১৮৭৫ সালে স্যার রিচার্ড টেম্পল চিড়িয়াখানা স্থাপনের জন্য একটি কমিটি গঠন করেন এবং বর্তমানে যে জায়গায় চিড়িয়াখানাটি রয়েছে, সেই জায়গাকেই আদর্শ স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হয়।
প্রাথমিকভাবে অবশ্য চিড়িয়াখানা নির্মাণের জন্য বরাদ্দ টাকার অঙ্ক শুনলে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যেতেই পারে। মাত্র ৫০০০ টাকা চিড়িয়াখানা নির্মাণের খরচ হিসাবে ধার্য করা হয়, অবশ্য তৎকালীন সময়ে এর মূল্য ছিল অনেক।
এরপরে ১৮৭৬ সালের ১ লা জানুয়ারী জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে চিড়িয়াখানা উদ্বোধন করা হলো এবং উদ্বোধন করতে এসেছিলেন স্বয়ং ইংল্যান্ডের রাজা প্রিন্স অফ ওয়েলস সপ্তম এডওয়ার্ড। কলকাতা চিড়িয়াখানা তো উদ্বোধন হলো ঠিকই কিন্তু প্রয়োজন ছিল পশুপাখির, সেই প্রয়োজন মেটানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল তৎকালীন পরিচালন কমিটি। প্রথমদিকে অবশ্য এই চিড়িয়াখানা গঠন করার জন্য কার্ল লুইসের ব্যক্তিগত পশু উদ্যান থেকে পশুপাখি নিয়ে আসা হয়। কার্ল লুইস জাতিগতভাবে ছিলেন একজন জার্মান এবং যিনি ভারতীয় রেলস্টেশনে বৈদ্যুতিকরণের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। শুধু লুইস সাহেবই নয়, ময়মনসিংহের রাজা সূর্যকান্ত আচার্যের সম্মানে ওপেন এয়ার টাইগার এনক্লোজার গড়ে তোলা হয়, যার নামকরণ করা হয়েছিল ময়মনসিংহ এনক্লোজার। ইতিহাস অবশ্য আমাদের আরও একটি দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে, তা হল সর্বপ্রথম ভারতীয় হিসাবে যে ব্যক্তি অর্থ সাহায্য করেছিলেন তিনি হলেন রাজেন্দ্র মল্লিক বাহাদুর এবং সেই মতো তার নামে একটি পশু কক্ষ নামাঙ্কিত হয়।
কলকাতা চিড়িয়াখানার প্রতিষ্ঠাতা
চিড়িয়াখানাকে সুনির্দিষ্টভাবে গড়ে তোলার জন্য যে ব্যক্তির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তিনি হলেন রামব্রহ্ম সান্যাল। চিড়িয়াখানার প্রথম সুপারেনটেনডেন্ট হিসেবে তাঁকে নিযুক্ত করা হয়েছিল। জুলজি প্রফেসর ডক্টর জর্জ কিং এর ছাত্র ছিলেন রামব্রহ্ম বাবু। দৃষ্টিশক্তিতে আংশিক অসুবিধা থাকার জন্য পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। প্রথমদিকে একজন সাধারণ কর্মচারী হিসেবে সান্যালবাবুকে নিযুক্ত করা হলেও কয়েকদিনের মধ্যেই তাঁর ওপর অনেক দায়িত্ব অর্পণ করা হয় এবং এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, সান্যাল মহাশয় সুপারেনটেনডেন্টের কাজ যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে পালন করেছিলেন। তাঁর কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি স্বরূপ জুলজিক্যাল সোসাইটি অফ লন্ডনের সদস্যপদ প্রদান করা হয়। নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রার মধ্যে কিভাবে পশুদের প্রজনন সম্ভব সেটাই করে দেখিয়েছিলেন রামব্রহ্ম সান্যাল। ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ প্রজনন বিদ্যার উপর লিখে ফেললেন একটি আস্তখানি বই যার নাম দেওয়া হলো “এ হ্যান্ডবুক অব দ্য ম্যানেজমেন্ট অব অ্যানিম্যালস ইন ক্যাপটিভিটি ইন লোয়ার বেঙ্গল”। তার অকল্পনীয় পরিশ্রম চিড়িয়াখানার মান অনেকাংশে উন্নত করে তুলল। ১৮৮৯ সালে সান্যাল বাবু করে দেখালেন মস্ত বড় এক ঘটনা, সুমাত্রান গন্ডারের প্রজনন ঘটালেন তিনি। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল কলকাতা চিড়িয়াখানায় নাম। যাকে অবশ্য অনেকেই আলিপুর চিড়িয়াখানা বলতে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চিড়িয়াখানার মুকুটে একের পর এক পালক জুড়েছে। ১৯৭০ এর প্রথম দিকে প্রথমবার সিংহ ও বাঘের মধ্যে ক্রস-ব্রিডিং ঘটানো হলো। টাইগন এবং লিটিগন জাতীয় সংকর প্রাণীর প্রজনন করে আলিপুর চিড়িয়াখানা বিশ্বদরবারে নিজেদের নাম আরও উজ্জ্বল করে তুলল। এরপর জন্ম নিল দুটি টাইগন। ১৯৭১ সালে রুদ্রাণী ও ১৯৭৩ সালে রঞ্জিনী।
বর্তমানে অবশ্য বিভিন্ন ইংরেজি সিনেমার দৌলতে আমরা বাঙালিরা অ্যানাকন্ডা জাতীয় বৃহৎ সাপের সঙ্গে পরিচিতি লাভ করেছি। তা চাক্ষুস দেখতে হলে অবশ্যই আপনাকে আসতেই হবে আলিপুর চিড়িয়াখানায়। গত বছর জুলাই মাসে চারটি বিশালাকৃতি অ্যানাকোন্ডা নিয়ে আসা হয় এবং তাদের সযত্নে রাখার জন্য ব্রাজিলের রেনফরেস্ট এর আদলে একটি শক্তিশালী এনক্লোজার তৈরি করা হয়। যেখানে রেইনফরেস্টর তাপমাত্রা ও পরিবেশ সৃষ্টি করা হয় এবং তার পাশাপাশি কৃত্রিম ঝর্ণা ও বৃষ্টিরও ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সমসাময়িককালে অবশ্য পরিসংখ্যান বলছে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা ৭৬ থেকে অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে, তা অবশ্য সুন্দরবনে। দর্শকদের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সময়ে একাধিক পশু-পক্ষী নিয়ে আসা হয় এই আলিপুর চিড়িয়াখানায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আলিপুর চিড়িয়াখানা তার চরিত্রও বদলেছে যেমন বর্তমানে অনলাইনে টিকিট কাটার ব্যবস্থাও রয়েছে। দর্শক টানতে আগ্রহী চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ নিত্যনতুন অনুষ্ঠানও পালন করে থাকেন। ইতিহাসের বেড়াজালে চিড়িয়াখানা হারিয়ে যায়নি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে পরিবর্তিত করেছে আর তাই পশু পাখির সংখ্যাও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। মাঝে অবশ্য কয়েকটা বছর চিড়িয়াখানার অবস্থা কিছুটা হলেও সংকটজনক হয়ে উঠেছিল কিন্তু বর্তমানে তা আবার চনমনে হয়ে উঠেছে তাই এখন দর্শকদের সামলাতে নাজেহাল হচ্ছেন চিড়িয়াখানার কর্মীরা।
Comments are closed.