কেরলের তিরুবনন্তপুরম থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরের এক অখ্যাত জায়গা। সেখানে সাজিকুমার মস্তানের ভয়ে একসময় কাঁপত সাধারণ মানুষ। এখন সেই সাজিকুমারের অটোতে উঠলে ক্যানসার আক্রান্ত মানুষের কোনও ভাড়া লাগে না। রকমারি ফুল গাছের টব আর বাচ্চাদের খেলনায় সাজানো তাঁর অটোরিকশাটাই যেন আস্ত এক বাগান। নিজের মতো করে সমাজসেবার কাজে নিয়োজিত হয়েছেন একদা জেল খাটা সাজিকুমার।
এ যেন দস্যু রত্নাকর থেকে ঋষি বাল্মীকি হওয়ার কাহিনি। খুব ছোট বয়সে বাবা-মা’কে হারিয়েছিলেন সাজিকুমার। দাদা আর দিদি তখন খুব ছোট। খিদের তাড়নায় মাত্র ১৩ বছর বয়সে অন্ধকার জগতে হাতেখড়ি তিরুবনন্তপুরমের এই বাসিন্দার। ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের ভয়ের কারণ হয়ে ওঠে সে। চুরি, ছিনতাই, খুন, জখমে হাত পাকায় সাজিকুমার। ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের ত্রাসের কারণ হয়ে ওঠেন তিনি। প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও তাঁকে নানা অসামাজিক কাজে ব্যবহার করত। মোটা টাকার সুপারি দিয়ে তাঁকে অনেকে খুন কিংবা অপহরণের কাজে লাগিয়েছে। দীর্ঘ কুড়ি বছরের বেশি সময় ধরে নানা অপকর্মে জড়িয়ে বারবার জেলে গিয়েছেন সাজিকুমার। অবশেষে ৩৫ বছর বয়সে এসে বোধোদয় হয় তাঁর। জীবনকে অন্যভাবে দেখতে শেখেন তিনি। বছর পাঁচেক আগে শেষবার জেল থেকে ফিরে আর অপরাধ জগতের দিকে পা বাড়াননি সাজিকুমার। প্রথমে নারকেল বেচে পাওয়া টাকায় সমাজসেবামূলক কাজ করতেন তিনি। এখন অটো চালিয়ে নিজের ক্ষুন্নিবৃত্তি মেটানোর পাশাপাশি ২৪ ঘণ্টা মানুষের কাজে লাগার চেষ্টা করেন সাজিকুমার। তিরুবনন্তপুরমের রিজিওনাল ক্যান্সার হাসপাতালে (আরসিসি) যাওয়া-আসা করা রোগী ও তাঁদের পরিবারকে বিনা ভাড়ায় পৌঁছে দেন সাজিকুমার। দুঃস্থ ক্যান্সার রোগী ও তাঁর পরিবারের লোকজনকে খাবার, পানীয় জল, সাধ্যমতো টাকা দিয়েও সাহায্য করেন তিনি। একরত্তি শিশুরা কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছে, তাদের পরিজনের চোখেমুখে বিষাদের ছায়া। এসব দেখে তাঁর চোখ ফেটে জল আসে। অসুস্থ শিশুদের মুখে একটু হাসি ফোটানোর জন্য অটোর ভিতরটা সাজিকুমার সাজিয়েছেন বিভিন্ন খেলনায়। স্থানীয়দের কাছে সাজিকুমার ‘আজি’ নামে পরিচিত। অটোতে এত গাছ-গাছালি কেন? আজির কথায়, বাড়ি ঘরদোর নেই, বাবার একমাত্র বাড়ি ছিল। তাও দিদিকে বিয়ে দেওয়ার সময় উপহার দিয়ে দিয়েছি। দাদা বিয়ে করে শ্বশুর বাড়িতেই থাকেন। সেই থেকে অটোই আমার ঘর-বাড়ি। বাবাকে দেখেছি একচিলতে জমিতে প্রচুর ফুল গাছ লাগাতে। এখন যেহেতু অটোই আমার বাড়ি-ঘর, একমাত্র ঠিকানা, তাই এখানেই বাগান করেছি।
নিজের চলে কীভাবে? হাসিমুখে আজি জানান, নিজের চাহিদা, প্রত্যাশা সবকিছুই সীমিত করে দিয়েছেন। দু’বেলা খাবার জুটলেই খুশি। তবে আজি স্বপ্ন দেখেন, একদিন এক কামরার একটা বাড়ি হবে তার, পাশে থাকবে ছোট্ট বাগান। সেই বাগানে খেলে বেড়াবে ছোট্ট শিশুরা। সজিকুমারের কথায়, সেই স্বপ্ন সত্যি হলে ভালো, না হলেও কিছু যায় আসে না। এই তো, বেশ আছি।
Comments are closed.