Miss Shefali: অলক্ষ্যেই ঝরে গেল সন্ধ্যারাতের শেফালি, ফিরে দেখা প্রবাদ প্রতিম ক্যাবারে ডান্সারের বর্ণময় জীবন
সত্যজিৎ রায় থেকে উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন কিংবা অমিতাভ বচ্চন, কে নেই তাঁর পরিচিতের তালিকায়? ক্যাবারে ডান্সার মিস শেফালির (Miss Shefali ) বিখ্যাত অনুরাগীর সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। ছয়ের দশকে তাঁর নাচের ছন্দে মাতোয়ারা ছিল পার্ক স্ট্রিট।
দীর্ঘ রোগভোগের পর বৃহস্পতিবার সকালে সোদপুরের বাড়িতে ঝরে গেল শেফালি। থেমে গেল মিস শেফালি ওরফে আরতি দাসের নাচের ছন্দ। ৭৬ বছর বয়সে মৃত্যু হল তাঁর।
ছ’ মাস বয়সে পূর্ববঙ্গ ছেড়ে কলকাতায় আসা, আহিরিটোলার বাড়িতে থেকে রাতের কলকাতার মিস শেফালি হয়ে ওঠা। কীভাবে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবারের সামান্য কাজ ছেড়ে আরতি ক্যাবারে নাচের পেশায় এসে শেফালি হয়ে উঠলেন, কেমন করে সুযোগ পান একাধিক বিখ্যাত বাংলা ছবিতে, কাজ করেন থিয়েটারে, কীভাবে কলকাতা, ক্যাবারে আর মিস শেফালি হয়ে উঠল সমার্থক শব্দ, জানুন তাঁর বর্ণময় জীবনের কথা।
জন্ম, ভিটে ছাড়া ও কলকাতার আশ্রয়
বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জে জন্ম আরতি দাসের। দেশভাগের সময় পরিবারের সঙ্গে কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে এ পার বাংলায় আসেন মিস শেফালি। তখন অবশ্য তিনি মিস শেফালি নন, আরতি।
ভিটে মাটি ছেড়ে আসা এই পরিবারটিকে প্রবল আর্থিক অনটনের মুখে পড়তে হয় কলকাতায় এসে। আহিরিটোলায় মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই হলেও ক্ষুন্নিবৃত্তির সুরাহা হল না। আরতির মা পরিচারিকার কাজ নিতে বাধ্য হলেন। বাবা কাজ করতেন একটি ফলের দোকানের সামান্য হিসাবরক্ষকের। এই সামান্য আয়ে সংসার চালানো ছিল খুবই কষ্টকর। ফলে কিশোরী বয়স থেকেই রোজগার করতে নামতে হয় আরতিকে। মাত্র এগারো বছর বয়সে কলকাতার চৌরঙ্গি এলাকার এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বাড়িতে পরিচারিকার কাজ নিলেন।
এই অ্যাংলো পরিবারে বিভিন্ন পার্টিতে খানাপিনা, নাচ হতে দেখে কিশোরী আরতির নাচের প্রতি একটা ভালোবাসা জন্মায়। দরজার পর্দার আড়াল থেকে সাহেব-মেমসাহেবদের নাচ দেখতেন তিনি। একদিন এভাবেই নাচ দেখতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে যান এক যুবক সাহেবের কাছে। তাঁর নাচের ইচ্ছের কথা শুনে তিনিই পরামর্শ দেন ক্যাবারে নাচের জগতে আসার।
বারো বছর বয়সে সেই যুবকের হাত ধরে ক্যাবারে নাচে হাতেখড়ি হল নিম্ন মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের মেয়েটির। প্রথম কাজ পেলেন পার্ক স্ট্রিট ফার্পোয়। ৭০০ টাকা মাইনে হাতে পেয়ে তো অবাক নাবালিকা। মাসভর খেটেও যা রোজগার হয় না, কয়েকদিন নেচেই এই রোজগার!
বাঙালি মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ে হোটেলে নাচছে, তাও আবার সেই ছয়ের দশকের কলকাতায়। আঘাত লাগল মধ্যবিত্ত মূল্যবোধে। বাড়ি থেকেই এল বাধা। বাবার আপত্তি। সমাজ ভালো ভাবে নিল না। নানা কথা উঠতে লাগল। কিন্তু সে সবে আমল দেননি আরতি। নাচের প্রতি প্রবল নেশা জাঁকিয়ে বসেছে, পারিবারিক বাধা, সমাজের কুকথা কানে না তুলে ইউরোপীয় নৃত্যশিল্পী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে থাকেন। শিখে ফেলেন চার্লসটন, ক্যানক্যান, ট্যুইস্ট, বেলি ড্যান্সিং।
মিস শেফালি ও পার্কস্ট্রিট
কিছুদিনের মধ্যেই পার্কস্ট্রিটের সাহেবি হোটেলগুলির আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠলেন আরতি। তখন তিনি আর আরতি নন, তাঁর নাম হয়ে গিয়েছে Miss Shefali (মিস শেফালি) । একের পর এক হোটেলে ক্যাবারে ডান্সার হিসেবে ঝড় তুলছেন মিস শেফালি। নর্তকী মানেই সহজলভ্য, পুরুষ মহলে এমন একটা ধারণা ছিল তখন। সে ধারণাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেন তিনি। শরীর নিয়ে তাঁর ছুৎমার্গ চলে গিয়েছিল অনেক আগে।
আত্মজীবনী ‘সন্ধ্যা রাতের শেফালি’ তে তিনি বলছেন, ‘আমি জানতাম, আমার শরীর সুন্দর। … আমি হোটেলে ক্যাবারে করতাম ঠিকই, কিন্তু আমি না চাইলে কেউ আমার গায়ে হাত ছোঁয়াতে পারত না।’ এমন শেফালির গুণমুগ্ধ ছিলেন অমিতাভ বচ্চন থেকে উত্তমকুমার।
ধীরে ধীরে সিনেমা ও থিয়েটার জগতেও পা রাখেন মিস শেফালি। বিশ্বরূপা থিয়েটারে তাঁর যোগদান ঘিরে প্রবল বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি কাজ করেছেন সত্যজিৎ রায়ের সীমাবদ্ধ ও প্রতিদ্বন্দ্বী ছবিতে। আরও বেশ কয়েকটি সিনেমায় দেখা গিয়েছে লাস্যময়ী নর্তকীকে। শোনা যায়, শুটিংয়ের প্রথম দিন গাড়ি করে তাঁকে নিজে নিতে এসেছিলেন সত্যজিৎ রায়।
ব্যক্তিগত জীবন যেমন বর্ণময়, আত্মজীবনীতেও তেমনি অকপট ছিলেন মিস শেফালি। কীভাবে উত্তমকুমার একা একা তাঁর নাচ দেখতে গিয়েছিলেন। কেন উৎপল দত্ত, অনুপকুমার কিংবা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো অভিনেতারা বাম মনোভাবাপন্ন হওয়া সত্ত্বেও তাঁর লড়াই, খেটে খাওয়ার মানসিকতাটা দেখতে পাননি তা নিয়েও সবিস্তারে নিজের অভিমানের কথা জানিয়েছেন।
শেষ জীবন
জীবন যুদ্ধে মিস শেফালিকে অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। দু’পা এগিয়েছেন তো, তিন পা পিছিয়েছেন। কিন্তু দমে যাননি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজ কমে আসে। আয়ও কমে যায়। পরিচিতরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। নাগের বাজারে একটি ফ্ল্যাট কিনেছিলেন। সেই ফ্ল্যাটে কে না এসেছেন। সেই ফ্ল্যাট বিক্রি করে উত্তর শহরতলির সোদপুরে ফ্ল্যাট কিনলেন। দেখার মতো কেউ ছলেন না। ভুগছিলেন কিডনির অসুখে। কিছুদিন দক্ষিণ কলকাতার একটি হাসপাতালে ভর্তিও ছিলেন।
অবশেষে বৃহস্পতিবার সকালে এক বর্ণময় জীবনের সমাপ্তি হল। পানিহাটি শ্মশানে যখন তাঁর মৃতদেহ এল, সঙ্গে লোকজন তেমন ছিল না। পাড়ার কিছু লোক, আর গুটিকয় আত্মীয়। শ্মশানে উপস্থিত অনেকে জানতেই পারলেন না, সন্ধ্যা রাতের যে শেফালি সকালেই ঝরে গিয়েছে, সেই Miss Shefali শুয়ে শেষ শয্যায়।
Comments are closed.