করোনাভাইরাসের আক্রমণ থেকে নিস্তার পায়নি পৃথিবীর কোনও দেশ। এই সংক্রমণের হাত থেকে মানুষকে রেহাই দিতে মাসের পর মাস লড়ে যাচ্ছেন বিজ্ঞান ক্ষেত্রের নানান মানুষ। তা সে চিকিৎসা করেই হোক, কিংবা দ্রুত ভ্যাকসিন আবিস্কারের গবেষণায় সফল হয়ে। এই মুহূর্তে প্রায় গোটা বিশ্বের মানুষ গৃহবন্দি। এই আদেশ মেনে চার দেওয়ালের ভেতর আটক স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবরা শহরের নাগরিকরা, যার মধ্যে রয়েছেন অনেক বাঙালিও।
যদিও এখানে স্কুলগুলি অনলাইন ক্লাস করাচ্ছে, উন্নত টেকনোলজির জন্য মোটামুটি সকলেই বাড়ি থেকেই অফিসের কাজও সেরে নিচ্ছেন! কিন্তু তা হলেও, হইচই প্রিয় মানুষ আমরা সবাই। এই আটক জীবনে কিছুদিন বাদেই শুরু হয়ে গিয়েছিল একটা মানসিক হাঁসফাঁস। তখনই এডিনবরাবাসী বাঙালির জীবনে খানিকটা হলেও এল একটু আনন্দের ছোঁওয়া। এডিনবরার বাসিন্দা কয়েকজন বাঙালির প্রচেষ্টায় গৃহবন্দি মানুষগুলোর জন্য একটু বিনোদনের ব্যবস্থা করা হল। যাঁরা গান গাইতে ভালবাসেন, তাঁদের একটা গাইবার সুযোগ, আর যাঁরা গানপ্রেমী তাঁদের ভিন্ন স্বাদের গান শোনার জন্য তৈরি হল একটা প্ল্যাটফর্ম। এই গৃহবন্দি জীবনে ‘গানবন্দী’ হল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের এমনই একটা অভিনব প্রয়াস, একটা প্রচেষ্টা মাত্র। স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবরায় বাঙালিরা রোজ সন্ধে ৬ টায় বসে পড়ছেন গান শুনতে ‘এডিনবরা ভেতো বাঙালি’ নামক ফেসবুক পেজে। ‘গানবন্দী’র পোস্টার তৈরি করেছেন সম্রাট ধর।
এই এডিনবরা শহরেই একদিন পড়শোনা করতে এসেছিলেন রসায়ন বিজ্ঞানের জনক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, ইউরোপীয় চিকিৎসা শাস্ত্রে শিক্ষিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা চিকিৎসক কাদম্বিনী গাঙ্গুলীর মতো দিকপাল বাঙালিরা।
এপার আর ওপার বাংলার গানের সংমিশ্রণে, গায়ক-গায়িকাদের পরিবেশনায় আস্তে আস্তে শুধু এডিনবরার নয়, যুক্তরাষ্ট্রের নানা শহরের বাঙালিরাও মেতে উঠেছেন। বিচিত্রানুষ্ঠান শুরু হয় ইউকের সন্ধে ৬ টায়। কলকাতায় তখন রাত সাড়ে ১০ টা, আর বাংলাদেশে রাত ১১ টা। সময়ের ব্যবধান তুচ্ছ করে, অনেক রাত পর্যন্ত ফেসবুক লাইভে এসে গান শুনিয়েছেন বহু শিল্পী। গায়ক এবং শ্রোতাদের উৎসাহ দেখে মনে হয়েছিল, হয়তো এই বিনোদনের চেষ্টাটা সার্থক হয়েছে। শিল্পীরা যাতে তাঁদের এই গানগুলো আরও প্রচার করতে পারেন, ‘গানবন্দী’ অনুষ্ঠানের সমস্ত গান অনুষ্ঠানের পরে ইউটিউবে দিয়ে দেওয়া হয়।
‘গানবন্দী’তে কারা গান গাইবেন সেটা শুরুর দিকে ঠিক করা হলেও, এখন আর তা হয় না। এই অনুষ্ঠান লোকমুখে এত সুনাম পেয়েছে যে, শিল্পীরা গান গেয়ে যাওয়ার পর তাঁর চেনা শিল্পী বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করছেন গান গাওয়ার জন্য। এইভাবে নিত্যনতুন শিল্পীরা আসছেন দুই বাংলার নানা প্রান্ত থেকে। খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের পাশাপাশি সম্ভাবনাময় নতুন প্রতিভারাও গাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন ‘গানবন্দী’তে।
‘গানবন্দী’র সূচনা হয়েছিল নববর্ষের ঠিক পরের দিন কোনও পরিকল্পনা ছাড়াই। এখনও পর্যন্ত ‘গানবন্দী’তে গান গেয়ে গেছেন ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায় , রুফ কনসার্ট-এর দেবদীপ মুখার্জি , ছায়ানট কলকাতার সোমঋতা মল্লিক, বাংলাদেশের নকশীকাঁথা ব্যান্ডের ভোকাল সাজেদ ফাতেমী, বিশিষ্ট গণসংগীত শিল্পী সুরাইয়া পারভীন লিরা, উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পী তুলিরেখা দত্ত, স্বনামধন্য লোকশিল্পী সুকন্যা রায় সরকারের মতো জনপ্রিয় শিল্পীরা। এর পাশাপাশি গান শুনিয়েছেন সুইডেনের স্টকহোম থেকে অনন্যা রায়, এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র আকাশদীপ দে, কানাডার টরন্টো থেকে দেবাঞ্জনা মুখার্জি, কলকাতা থেকে নন্দিতা নায়েক, রূপসা চ্যাটার্জি, দেবোপম গোস্বামী, নন্দিনী বসু সরকার এবং অর্পিতা ইন্দ্র। বাংলাদেশের আরিফ রহমানের মা মাটি মানুষে গান, সন্দীপন দাসের গলায় ‘ওরে হালা ভোমরা’, সোমা দাসের গলায় অতুলপ্রসাদী গান, বর্ণালী সরকারের নজরুল সংগীত, উত্তম কুমার শর্মার রবীন্দ্রসংগীত, শান্তা সরকারের লোকগীতি, মানসী সাধুর আধুনিক ও মৌলিক গান, মায়েশা সুলতানা উর্বীর দেশের গান এডিনবরার প্রবাসী বাঙালিদের মন জয় করেছে।
দীর্ঘ আট বছর ক্যান্সারের মতো প্রাণঘাতী রোগের সঙ্গে লড়াই করছেন রিনা ফেরদৌসি। তিনিও গান গেয়েছেন ‘গানবন্দী’ অনুষ্ঠানে। বিলেতের শিল্পীরাও যোগদান করেছেন ‘গানবন্দী’তে। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য লন্ডনবাসী চিকিৎসক শামা পারভীন এবং লিডসের ইঞ্জিনিয়ার অভ্র ভৌমিক। অদিতি দে’র সঙ্গে গীতি আলেখ্য ‘বৃষ্টি দ্বৈরথ’ পরিবেশন করেছি আমি। এই সপ্তাহেও ‘গানবন্দী’র ক্যালেন্ডার ভর্তি। আগামী দিনে যাঁরা আসছেন তাঁরা হলেন সমীক কুন্ডু, সুনন্দা বাগচি, ফয়সাল ইফতিখার রাজা , সৃজিত চক্রবর্তী।
একুশে পদক প্রাপ্ত গান জগতের কিংবদন্তি, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম কন্ঠযোদ্ধা, উপমহাদেশের বরেণ্য গণসঙ্গীতশিল্পী ফকির আলমগীর গানবন্দীতে এক বিশেষ অনুষ্ঠান করবেন। এডিনবরার সব বাঙালি অপেক্ষায় আছেন এই অসামান্য মানুষটির গান শোনার জন্য। গানবন্দী সমাপ্ত হবে ১৭ মে, রবিবার।
গানবন্দীর সব শিল্পীকে ধন্যবাদ জানিয়ে এডিনবরার প্রবাসী বাঙালিরা ছবি এঁকে, কবিতা লিখে উপহার দিচ্ছেন। এই বাঙালিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সঞ্চারী মৈত্র, প্রগতি সাহা নিয়োগী, স্বাগতা সেন, সোনানী ব্যানার্জি।
বিলেতে করোনাভাইরাসের প্রভাবে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৩২ হাজার মানুষের। এর মধ্যে ভারত আর বাংলাদেশের বহু প্রবাসী নাগরিক এই সংক্রমণের কবলে প্রাণ হারিয়েছেন অকালেই। গানবন্দীর মতো এক অনুষ্ঠান এখন মানুষের মনের বিষন্নতা দূর করেছে অনেকটা। রোজ সন্ধে হলেই প্রবাসী বাঙালিরা গান শুনছেন। সব রকমের গান, লোকগানের প্রাচীনতম ধারা পুঁথি গান থেকে শুরু করে, রবীন্দ্র-নজরুল সঙ্গীত, বাউল কীর্তণ, আধুনিক, সব। গানই পারবে মানুষের মনের সমস্ত অস্থিরতা দূর করে প্রশান্তি এনে দিতে।
Comments are closed.