ধনখড় পশ্চিমবঙ্গকে কাশ্মীর বানাতে চান! নির্বাচন বন্ধ রেখে ছ’মাস করে রাষ্ট্রপতি শাসনের মেয়াদ বাড়িয়ে বকলমে নিজের শাসন কায়েম করতে চাইছেন

পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে ততই বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রবনতার মধ্যে তৈরি হচ্ছে নতুন বিন্যাস। বাম কংগ্রেস

ঐক্য, বিজেপির তৎপরতা কিংবা তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক ধারাঅব্যাহত রয়েছে। রাজ্য রাজনীতি ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। জেলাভিত্তিক কিছু সমস্যা বা সঙ্ঘাতের খবর পাওয়া যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে নতুন নয়। তবে বলার বিষয় হল, তিন পক্ষই সমদূরত্ব বজায় রেখে এগোনোর চেষ্টা করছে। চোখে চোখ রেখে পরস্পরকে মেপে নেওয়ার প্রয়াস অব্যাহত আছে। নির্বাচনের দিন যত এগিয়ে আসবে রাজনৈতিক দলগুলির তৎপরতা ততই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে। সেটাই স্বাভাবিক। রাজনৈতিক হিংসার সম্পূর্ণ অবসান হয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হোক, আমরা সেটাই চাই। বাংলার জনসমাজ সমস্ত রকম বিবেক, অনুভূতি বিসর্জন দিয়ে বসে নেই যে, সুদূর রাজস্থান থেকে কেউ এসে আমাদের উপদেশ দেবেন, আর আমরা নতমস্তকে সেটা মেনে নেব। দিল্লিতে বসে বাংলার নিন্দে করবেন অথচ আমাদের চেতনা জাগ্রত হবে না, এমনটা ভাবা ভুল।

রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় যেটা করছেন তা শুধু অভূতপূর্ব নয়, সম্পূর্ণ অনৈতিক এবং অনভিপ্রেত। রাজ্য সরকারের সমালোচনা তিনি করতে পারেন কি পারেন না তাই নিয়ে সাংবিধানিক চর্চা অনেক হয়েছে, আমি তা নিয়ে বিশেষ কিছু বলতে চাইছি না। রাজ্যপাল প্রতিনিয়ত যে সাংবিধানিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করছেন, যেভাবে মিডিয়াকে ব্যবহার করছেন তা নিয়ে অনেকেই অনেকদিন ধরেই সোচ্চার । সেটা প্রায় ক্লিশে হয়ে গেছে। রাজ্যপালের বিশেষাধিকারের মধ্যে এটা পড়ে না। বস্তুত রাজ্যপালের বিশেষাধিকারের ধারণাটিই এই রাজ্যের ক্ষেত্রে অচল। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলি এবং যেখানে সংবিধানের ষষ্ঠ তফশিল অনুযায়ী বোর্ড আছে সেখানে রাজ্যপালের কিছু সাংবিধানিক বিশেষাধিকার রয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে তো সেটাও নেই। রাজ্যপাল মন্তব্য করতে পারেন, মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে জানতে চাইতে পারেন, মুখ্যমন্ত্রীকে পরামর্শ দিতে পারেন। কিন্তু সবটাই হবে নেপথ্যে। সরাসরি মিডিয়ার সামনে রাজ্য সরকারকে তুলোধোনা তো করবেন বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দ। বিরোধীরাও যদি রাজ্যপালের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন তবে তো শাসক দলেরই লাভ। কিন্তু সেটা বড়ো কথা নয়। আশ্চর্যের হল রাজ্যপালের নতুন ভূমিকা।

রাজ্যপাল রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানাবেন এতে নতুনত্ব কিছুই নেই। এর আগেও এমন ঘটনা বহুবার ঘটেছে । কিন্তু নতুন যে কাণ্ডটা মাননীয় রাজ্যপাল করলেন তা হল সাংবাদিক সম্মেলন করে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আমলা এবং সমগ্র রাজ্য প্রশাসনের তুমুল সমালোচনা। তিনি উপাচার্যদের সমালোচনা করলেন এবং মাত্রা ছাড়িয়ে বলে দিলেন এরকম চলতে থাকলে ভোট হবে কীভাবে ? তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল দুটি। রাজ্যপাল সরকারি আমলাদের কাজের বিষয়ে জানতে চাইতে পারেন কিন্তু কখনই তাঁদের কাজ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন না, কারণ আমলারা কাজ করেন সরকারের নীতি রুপায়নের জন্য। সরকারি নীতি রাজ্যপাল কখনই ঠিক করবেন না। সংবিধান তাঁকে সেই অধিকার দেয়নি। সর্বোপরি বোঝাই যাচ্ছে যে তিনি রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে চাইছেন। সেক্ষেত্রে এই আমলারা তাঁর হয়ে কাজ করবেন তো?

কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য সেটা নয়। আমাদের স্তম্ভিত করেছে শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর মনোভাব দেখে। তিনি তো আর শিক্ষাবিদ নন। শুনেছি তিনি আইনজীবী। কিন্তু এর আগে কখনও কোনও রাজ্যপাল যে কাজ করতে সাহস পাননি তিনি সেটাই করলেন। আচার্য হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিন্দে করলেন প্রকাশ্যে। সর্বভারতীয় মিডিয়ার সামনে। এই অধিকার তাঁকে কে দিল ?

শুধু তাই নয়। এর আগে একাধিকবার তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে ঢুকেছেন নিজের ইচ্ছানুযায়ী। এটা তিনি কি করতে পারেন ? রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছেন এ রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই না জেনে। কখনও তাঁর মুখে সত্যেন বসু, জগদীশ চন্দ্র বসু, মেঘনাদ সাহার বিজ্ঞান চর্চা বা সুনীতিবাবুর ভাষা চর্চার  বিষয়ে কিছু শুনিনি। পশ্চিমবঙ্গের লেখাপড়া চর্চার বিষয়ে কিছুই না জেনে রাজ্যপাল মহোদয় কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন এবং সরাসরি সবাইকে নির্দেশ দেন? তাঁর অন্তত প্রধানমন্ত্রীর কাছে শেখা উচিত ছিল  কীভাবে বিশ্বভারতীর আচার্য হওয়া সত্ত্বেও তিনি এত গোলমালে একটি মন্তব্যও করেননি। অথচ মাননীয় রাজ্যপাল কেউ না চাইলেও অযাচিত মন্তব্য করেন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে উদ্ধার করতে নিজে চলে যান। এটা তাঁর মহানুভবতা নয়, নির্ভেজাল হটকারিতা। তিনি কীভাবে দিল্লিতে সাংবাদিক সম্মেলন করে পশ্চিমবঙ্গের উপাচার্যদের সম্পর্কে মন্তব্য করলেন ? নিজে শিক্ষাবিদ না  হয়ে, এই রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে কোন ধারণা না নিয়ে এমন মন্তব্য কখনই করা যায় না। এতে তিনি উপাচার্যদের ছোট করলেন না শুধু, নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও ভুল ধারণার প্রকাশ ঘটালেন। যদি সত্যি এ রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রে কোনও অবদান রাখতে চান তাহলে অবশ্যই অনেক বেশি বিনয়ী হতে হবে। রাজনীতি করবো আবার শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতিও ঘটাবো, দুটি কাজ একসাথে হয় না। শিক্ষার জন্যই এ রাজ্যে এক একটি গোটা জীবন অতিবাহিত হয়ে গেছে। তার খবর কী রাখেন রাজ্যপাল মহোদয় ?

তবে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক তাঁর নির্বাচন সংক্রান্ত উক্তি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে তাঁর নিভৃতে কী কথা হয়েছে তা আমরা শুনতে যাব না নিশ্চয়ই, কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য তিনি নির্বাচন সংক্রান্ত যে প্রকাশ্য বক্তব্য পেশ করেছেন তা সম্পূর্ণ অনধিকারচর্চা। নির্বাচন করবে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন। রাজ্যপাল নন। আইন-শৃঙ্খলা দেখার দায়িত্ব রাজ্য সরকারের। কিন্তু নির্বাচন ঘোষণার পর তা মূলত কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের হাতে চলে যাবে। রাজ্যস্তরের আমলারাও নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী চলবেন। এখানে রাজ্যপালের কোনও ভূমিকাই নেই। যদি রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়, তাও নেই। তাহলে কীসের ভিত্তিতে তিনি এই কথা বলছেন? এখানেই আমাদের বলার কথা এটাই যে, রাজ্যপাল অত বোকাও নন। তিনি চাইছেন নির্বাচন বন্ধ রেখে ছয়মাস ছয়মাস করে রাষ্ট্রপতি শাসনের মেয়াদ বাড়িয়ে বকলমে নিজের শাসন কায়েম করতে। তাঁর বিভিন্ন অযাচিত কাজকর্ম ও কথাবার্তা তেমনই ইঙ্গিত করছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গকে কাশ্মীর বানাতে চাইছেন। নিজে হতে চাইছেন জগমোহনের মতো একজন রাজ্যপাল। ভুল ভাবছেন রাজ্যপাল মহোদয়। তেমন চেষ্টা শুরু করেই দেখুন, এ রাজ্যের নাগরিক সমাজ তৈরি আছে তা ব্যর্থ করতে।

 

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

 

Comments are closed.