দাঙ্গার ইতিহাস সুপ্রাচীন। পৌরাণিক আমল থেকেই নানা রকমের দাঙ্গা বা রায়ট পৃথিবীতে ঘটে চলেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বা শক্তিশালী মানুষরা সংখ্যালঘু কিংবা দুর্বল মানুষদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য নানা পথ অবলম্বন করে। মুখোমুখি যুদ্ধ এককালে হোত বটে, তবে তাতে যে দুর্বল মানুষদের সায় থাকতো এমন নয়। কিছুটা প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে, আত্মরক্ষার প্রয়োজনে তারা লড়াই করেছে, লুকিয়ে থাকলেও রেহাই মেলেনি, গণহত্যা চলেছে সেক্ষেত্রে। দাঙ্গার পিছনে সব সময় থাকে কিছু মিথ্যা প্রচার। গণমাধ্যম যত শক্তিশালী হয়েছে, দাঙ্গাবাজরা ঠিক ততটাই ক্ষমতাবান হয়েছে। কারণ এই মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে তারা মিথ্যা প্রচার চালাতে পেরেছে, ছড়িয়ে দিতে পেরেছে তাদের ঘৃণাকে। আম-জনতার মধ্যে সেই মিথ্যে, ঘৃণা ধীরে ধীরে রূপ নিয়েছে সংখ্যালঘুদের প্রতি, দুর্বলদের প্রতি আক্রোশের। আর এই সুযোগে স্বার্থান্বেষীরা শুরু করেছে মেরুকরণ এবং তৈরি করেছে দাঙ্গার জমি। যে কোনও দাঙ্গার পিছনে অর্থনীতি সবচেয়ে জরুরি ভূমিকা পালন করে। আর এই সেই অর্থনীতি যাকে চালনা করে রাজনীতি।
সাম্প্রতিক কালে সামাজিক গণমাধ্যম দাঙ্গায় বীজের ভূমিকা পালন করে। জমি তো প্রস্তুত করাই রয়েছে। ঠিক এক বছর আগে বসিরহাটের বাদুড়িয়ায় যে দাঙ্গা সংঘঠিত হয়েছিল, তার পিছনে ছিল ফেসবুকীয় একটি পোস্ট। যা নাকি ইসলাম ধর্মের অবমাননা করেছিল। তাতে যখন মুসলমান মানুষ ক্ষেপে গেলেন, বা বলা ভাল, প্ররোচনায় পা দিলেন, ঠিক তখনই তাদের কাজ হাসিল করতে নেমে পড়ল দাঙ্গাবাজরা। যে সব মুসলমান ধর্মরক্ষার জন্য মাঠে নেমে পড়ল, তারা আসলে ফেসবুকের ওই পোস্টের চেয়েও নিজ ধর্মের অধিক অপমান করল। কে ছিল বাদুড়িয়া দাঙ্গার খলনায়ক! ওই পোস্ট নাকি মুসলিম কিছু মানুষের ধর্ম অবমাননার প্রতিক্রিয়া? উত্তর এত সহজ নয়। এর জন্য দায়ী এক বিশেষ রাজনীতি, যারা ধর্মের সুড়সুড়িকে হাতিয়ার করে ক্ষমতায় আসতে চায়। তারা সুপ্ত জাতিবিদ্বেষকে কাজে লাগিয়ে দ্বিকোটিক বিভাজনের খেলায় বহু ক্ষেত্রে সফল হয়েছে। আপাতত তাদের লক্ষ্য এই বাংলা। তাই এত উস্কানি, এত ঘৃণার প্রচার। এই প্রচার রোজ বাড়ছে একটু একটু করে। আগুনের মতো। তারা জানে, এমন ভয়ঙ্কর খেলায় ক্ষমতা লাভের পথ প্রশস্ত হয়। গরিষ্ঠের মনে লঘিষ্ঠ সম্পর্কে ঘৃণার বীজ বপন করে দিলেই ওই ধর্মের একমাত্র ধ্বজাধারী হিসাবে তাদের ব্যালট বাক্স উপচে পড়বে। বসিরহাটের যে ইমামের চোখে দাঙ্গাবাজরা অ্যাসিড ছুড়ে মারল, যিনি অন্ধ হয়ে গেলেন, তিনিও হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে বললেন, এর যেন বদলা কেউ না নেয়, দাঙ্গা থামানো দরকার।
দাঙ্গার বিপ্রতীপে বাস করেন যাঁরা, তাঁরা মানে আমরা কী করছি! যাঁরা দাবি করেন যে তাঁরা উদার, ধর্মনিরপেক্ষ বা শান্তির পক্ষে, তাঁদের ভূমিকা ঠিক কী? বেদনার সঙ্গে বলতে হয়, তাঁদের মানে আমাদের ভূমিকা খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। সাম্প্রদায়িকতাবিরোধীদের অধিকাংশও ঘৃণাপ্রচারকারীদের শিকার হয়েছেন তাঁদের অজান্তেই কিংবা নিরন্তর মিথ্যা প্রচারে তাঁদের মস্তিষ্কেও বাসা বেঁধেছে যুক্তিহীনতা। সম্প্রতি দিব্যা ও আসিফার ধর্ষণ নিয়ে শুরু হয়েছে তুলনা। আসিফার ক্ষেত্রে ক্ষমতাবানেরা, মন্ত্রীরা ধর্ষকের পক্ষে মিছিল করেছিল, দিব্যার ক্ষেত্রে অভিযুক্ত গ্রেপ্তার হয়েছে, মামলার জন্য ফাস্ট ট্র্যাক আদালত বসেছে। দিব্যার ক্ষেত্রে কেউ অভিযুক্তের পক্ষ নেয়নি, আসিফার ক্ষেত্রে নিয়েছিল। যে কোনও সভ্য মানুষ দিব্যা ও আসিফার পাশে সমানভাবে আছেন। কিন্তু ওই যে গুলিয়ে দেওয়া! আসিফা তোমাদের, দিব্যা আমাদের। এইভাবে সভ্য সমাজও আসলে ঢুকে পড়ছে ভয়াবহ কুম্ভীপাকে!
যে কথা হচ্ছিল। বসিরহাটের দাঙ্গা। বাদুড়িয়ার মতো ‘সামান্য’ একটি ঝামেলার পেছনে যে যে কারণ আছে তা চিহ্নিত করতে না পেরে কিংবা ইচ্ছে করে চিহ্নিত না করে তাঁরা বলতে শুরু করেছেন, সব ধরণের মৌলবাদ সমান বিপজ্জনক। হিন্দু মৌলবাদের পাশাপাশি সমানভাবে মুসলমান মৌলবাদের নিন্দা করতে হবে, দুটিকেই সমান বিপজ্জনক বলতে হবে। এই খানে গুজরাত মডেলের প্রাথমিক সাফল্য। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলেও এটা সত্যি যে মুসলমানরা এ দেশে ক্রমশ গৌণ নাগরিক হয়ে উঠেছেন। শুধু সন্দেহের বশে তাদের পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা এখন রোজনামচা। দুর্বলের কোনও শক্তি নেই দাঙ্গা করার। বরং দাঙ্গা হলে যাবতীয় ক্ষতি তাঁদেরই। ভারতে আজ পর্যন্ত যত দাঙ্গা হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন সংখ্যালঘুরাই। দিনের পর দিন অজ্ঞতা, ঘৃণা আর তাচ্ছিল্য পেতে পেতে সংখ্যালঘুরা আজ মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন। তাঁদের উপর এখন নতুন খাঁড়া হল সামাজিক গণমাধ্যমে ছড়ানো বিদ্বেষ, যা মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যায়।
মনে রাখতে হবে, দাঙ্গায় কিংবা সামাজিক বিপর্যয়ে সকলে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কেউ যদি মনে করেন, দাঙ্গা হলে তাঁর ভয় নেই ক-খ-গ প্রভৃতি কারণে, তিনি ভুল বুঝছেন। পাশের বাড়ির আগুনের তাপ থেকে রেহাই পাওয়া দুষ্কর। সমাজের বিভেদকামীরা তাদের লক্ষ্যে বহুদূর এগিয়ে গিয়েছে, সমন্বয়বাদীরা অনেক পিছনে। আজও যদি সতর্ক না হই, জোটবদ্ধ হতে না পারা যায়, দাঙ্গাকে-মিথ্যাকে প্রতিহত করতে না পারি; তবে আমরা ও আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম পড়বে অকূল পাথারে, নোয়ার কোনও নৌকা আমাদের বাঁচাতে আসবে না।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)