বনেদিয়ানার কবল থেকে ছাতাকে সাধারণের নাগালে এনেছিলেন, জানেন সঙ্গীতপ্রেমী মহেন্দ্র দত্তের উত্তরণের কাহিনি?

”People don’t know what they want until you show it to them.”
মন্তব্যটি অ্যাপল-এর প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জোবসের। হয়তো একইরকম ভেবেছিলেন বাঙালি ব্যবসায়ী মহেন্দ্র দত্তও। ছাতা নামক সম্ভ্রান্ত শ্রেণির আভিজাত্যের প্রতীককে যিনি মধ্যবিত্ত গৃহস্থ বাড়ির নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, তাঁর নাম মহেন্দ্র দত্ত।
যে জিনিসটির বহুল ব্যবহারই নেই, তাকে দিয়েই কীভাবে দেশজুড়ে ব্যবসা করার ছক কষে ফেলেন বেনিয়াটোলা লেনের বনেদি বাড়ির যুবক? আসলে সময়ের থেকে যাঁরা এগিয়ে থাকেন, যাঁরা অনুভব করতে পারেন আগামীতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে সভ্যতা ও জীবনধারা, তাঁরাই তো রাস্তা দেখান। হয়ে ওঠেন পথিকৃৎ।
তখন দেশে ব্রিটিশ রাজ চলছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া রাজত্বে ধুঁকছে দেশীয় ব্যবসা। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে কেরানির চাকরি হয়ে উঠেছে অন্যতম জীবিকা। সম্ভ্রান্ত ও বিত্তশালীরা তখন রায়বাহাদুর খেতাব পাওয়ার লড়াইয়ে দৌড়চ্ছেন। গঙ্গার দু’পাড়ে গজিয়ে উঠছে একের পর এক বাগানবাড়ি। সেই সময়ে আর এক সম্ভ্রান্ত বনেদি বাড়ির যুবক স্বপ্ন দেখছেন ব্যবসা করে দেশজোড়া নাম করবেন। বেশিরভাগ বনেদি পরিবারের যুবক যখন বিলাস-ব্যাসনে জীবন উপভোগ করতে ব্যস্ত, মহেন্দ্র দত্ত তখন শুরু করে দিয়েছেন পুরোদস্তুর স্টার্টআপ বিজনেস। শুধু ব্যবসাই নয়, রীতিমতো ব্র্যান্ডিং-এ জোর দিয়ে খুলে ফেলেছেন ‘Mohendra Dutt & Sons’ নামে কোম্পানিও।
স্রেফ ছাতার ব্যবসা করে যে সময়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্নে তিনি বিভোর, তখন কিন্তু ছাতা ব্যবহার করতেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্যরা। তাও আবার পুরুষরা নন, মহিলারা। গ্রামে তেমন চলই ছিল না ছাতার। কিন্তু ওই যে, মানুষ নিজেই জানে না তারা কী চায়, যতক্ষণ না তাদের সেটা দেখানো হচ্ছে। এভাবেই সাধারণ গৃহস্থ ঘরেও আবশ্যিক উপকরণ হিসেবে ছাতাকে যাঁরা জায়গা করে দেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম নাম মহেন্দ্র দত্ত। সঙ্গীতকার ও বাদ্যকর থেকে ব্যবসায়ী মহেন্দ্র দত্তের উত্তরণ ও সাফল্য ছিল চোখধাঁধানো।
যে ব্যবসা তখনকার হ্যারিসন রোড থেকে বর্তমানের এম.জি. রোডে প্রবহমান। ২৬, বেনিয়াটোলা লেনের বসতবাড়িতেই ১৮৮২ সালে মহেন্দ্র দত্ত ছাতা বানাতে শুরু করেন। কুটির শিল্পকে স্টার্ট আপ বিজনেসের রূপ দেন পরে। ১৮৮২ সাল থেকে ১৯০৯ সাল, দীর্ঘ ২৭ বছর কলকাতার বুকে চুটিয়ে ব্যবসা করেছেন মহেন্দ্র দত্ত। উদয়াস্ত পরিশ্রম করে ইংরেজ আমলেও নিজের ব্যবসাকে দিয়েছেন স্বতন্ত্র পরিচয়।
১৯০৯ সালে অকাল মৃত্যু হয় মহেন্দ্র দত্তের। মহেন্দ্র দত্তের মৃত্যুর সময়ে দুই ছেলে ভবানীচরণ ও তারিণীচরণ নিতান্তই নাবালক। পরিবারের বাকিরা কোনও মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীর হাতে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসাকে বিক্রি করার সওয়াল করলেন। কিন্তু রুখে দাঁড়ালেন মহেন্দ্রর স্ত্রী রাধারানি দেবী। রীতিমতো কোর্ট-কাছারি করে মামলা জিতে নিজের হাতে পান স্বামীর ব্যবসা। সময়ের হিসেবে মহেন্দ্র পত্নী রাধারানিও ছিলেন অনেক এগিয়ে। মহিলা ক্ষমতায়নের এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। যে সময়ে মহিলাদের জীবন বাড়ির অন্তঃপুরে ঘুরপাক খেত, জানলার খড়খড়ি বা পালকির পর্দার ফাঁক দিয়ে তাঁদের বাইরে চোখ রাখতে হত, সে সময়ে দাঁড়িয়ে স্বামীর ব্যবসার ভার নিজের কাঁধে তুলে নেন মহেন্দ্র-জায়া। বেশ কয়েক বছর নিজের হাতে ব্যবসা টেনে নিয়ে যাওয়ার পর মাত্র ১৭ বছর বয়সে মহেন্দ্রর বড় ছেলে ভবানীচরণ এসে ব্যবসার হাল ধরেন। সেই সঙ্গে সমানতালে চালিয়ে গিয়েছিলেন পড়াশোনা। তাঁর সময়েই মহেন্দ্র দত্ত অ্যাণ্ড সন্স্-এর ছাতায় আসে আধুনিকতার ছোঁয়া। নতুন জোয়ার আসে ব্যবসায়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছাতার স্টাইল ও টেকনোলজি, দু’টো দিকেই পরিবর্তন আনেন ভবানীচরণ। বিদেশ থেকে মেশিন ও কাঁচামাল নিয়ে আসেন। দেশের সেরা ছাতা কোম্পানি হিসেবে মহেন্দ্র দত্ত অ্যাণ্ড সন্স্-কে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন তিনি।
ভবানীচরণের চার ছেলে। বড় ছেলে আশুতোষ, মেজো অপূর্ব, সেজো অশোক এবং ছোট তুষার দত্ত। ভবানীচরণের অবর্তমানে পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরেন বড় ছেলে আশুতোষ। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পাঠ অসমাপ্ত রেখে পারিবারিক ব্যবসায় ঢোকা আশুতোষ আবার ছাতার ব্যবসার মধ্যেই আটকে থাকেননি। ছাতার পাশাপাশি তিনি প্রিন্টিং মেশিন তৈরি, ফিল্ম প্রোডাকশনের ব্যবসাতেও সফল হন। এই সময়ে পারিবারিক ব্যবসা ভাগ হয়ে যায়। আশুতোষ নেন মহেন্দ্র দত্ত অ্যাণ্ড সন্স্ নামটি। এঁদের কাকা তারিণীচরণ এবং তাঁর পুত্ররা নেন মহেন্দ্র দত্ত গ্র্যা্ণ্ড সন্স নাম। অন্যদিকে ভবাণীচরণের ছোট পুত্র তুষার দত্ত সম্পত্তি তিন টুকরো হওয়ার পর মহেন্দ্রলাল দত্ত, সংক্ষেপে এম.এল.ডি. আমব্রেলা নাম সম্বল করে নতুন করে ব্যবসা শুরু করেন। তার আগে বেনিয়াটোলা লেনের আদি বাড়ি ছেড়ে তিনি চলে যান বালিগঞ্জের কর্নফিল্ড রোডের দোতলা একটা বাড়িতে। ১৯৭৭ সালে গড়িয়াহাট রোডে দোকান খোলেন। এদিকে মহেন্দ্র দত্ত অ্যাণ্ড সন্স্-এর ব্যবসা যায় আশুতোষের পুত্র তথা মহেন্দ্র দত্তের প্রপৌত্র কালীনাথ দত্তের হাতে। সেখান থেকে তাঁর পুত্র সুভাষ দত্তের হাতে এখন মহেন্দ্র দত্ত অ্যাণ্ড সন্স্-এর দায়িত্ব।
তবে বহুবার পারিবারিক সম্পত্তি ভাগ হলেও মহেন্দ্র দত্তের ছাতা ব্যাঙের ছাতায় পরিণত হয়নি। সময় বদলে গেলেও মহেন্দ্র দত্ত অ্যাণ্ড সন্স্-এর তৈরি ছাতা, রেনকোট, ব্যাগের চাহিদা ও বিক্রি আজও ঊর্ধ্বমুখী। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতিতে আবার মাস্ক-ও বিক্রি করছে তারা।
ইন্টারনেটে ছাতা নির্মাতা মহেন্দ্র দত্ত নাম লিখে সার্চ করলে প্রথমেই আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠবে গুগল ম্যাপ। কলকাতার মহাত্মা গান্ধী রোডের দোকান শোরুমের অনেক ঠিকানা আর কোন দোকানে কী কী ধরনের ছাতা পাওয়া যায় তার লম্বা ফর্দ। প্রায় ১৩৮ বছর আগে ঠিক এই স্বপ্নই দেখেছিলেন সঙ্গীতকার থেকে ব্যবসায়ী হওয়া মহেন্দ্র দত্ত।

Comments are closed.