কথাটা সেদিন উঠেছিল।
দক্ষিণ কলকাতার যে চৌমাথাকে আগে আমরা রবীন্দ্র সদন বলতাম, তারপর এক্সাইড বলতাম, আজকাল হলদিরাম বলি, সেখান থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে বিরজি তলাওয়ের ধারে পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির তেতলা দালান। তার একতলাতে তৃপ্তি মিত্র সভাগৃহ। ব্ল্যাকবক্স থিয়েটারের একটা আদল আছে ওতে। ইদানীং অনেকেই এখানে নাটক করছেন। সেদিনও নাটক ছিল। তার আগে একটা অনুষ্ঠান ছিল। তমাল মুখোপাধ্যায় নামের এক উদ্যমী প্রযুক্তিবিদের নেতৃত্বে ‘কলকাতা ক্যানভাস’ নামের একটা ওয়েবসাইট বেশ কিছুদিন ধরে সাইবার স্পেসে আছে। এবারে ‘থিয়েটারি মাসকাবারি’ নামে একটা ওয়েবজিন বেরোল। নাগেরবাজারের যুবক তমাল দিনে দিনে দল পাকিয়েছেন। কলকাতা ক্যানভাস দলে ভারি হয়েছে। সেদিন নাট্যকার তথা মন্ত্রী ব্রাত্য বসুকেও পাশে পেয়ে গেলেন তমাল। আরও অনেকে এলেন। নানান বয়সের নোটোদের ভিড়ে মোটের ওপর ভরে গেল তৃপ্তি মিত্র সভাগৃহ।
অনেক কথা হল। ডিজিটাল রেভোলিউশনের সামনে পড়ে গণমাধ্যমের চেহারা কীভাবে বদলাচ্ছে সে সব নিয়ে ব্রাত্য বললেন। কীভাবে আমাদের সাংবাদিকরাও খবরের কাগজ, নিউজ চ্যানেলের চাকরি ছেড়ে ওয়েবসাইট খুলছেন তার হদিশ দিলেন। পরিসংখ্যানের দৌলতে সে সব কথা আমাদের কপালে ভাঁজ ফেলল। আরও কথা হচ্ছিল। নাট্যদল পরিচালকের নজর দিয়ে তপনজ্যোতি দাস দেখছিলেন কীভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলা বাজারি কাগজের বিজ্ঞাপনের হার তাঁদের মতো দলকে প্রমাদ গুণতে বাধ্য করছে। নির্দেশক দেবাশিস রায়ের মনে হচ্ছিল ফেসবুকের পাতায় যে সব আনকোরা দর্শক থিয়েটার নিয়ে আঁকাড়া মন্তব্য করছেন সেগুলো খবরের কাগজ বা পত্রপত্রিকার সাবেক আন্দাজের রিভিউয়ের চাইতে অনেক বেশি মূল্যবান। নট অশোক মজুমদার বলছিলেন, বেলঘড়িয়া অভিমুখের ‘কোজাগরী’-র প্রচারের অভিমুখ হয়ে উঠে কীভাবে বিপণনের এক নির্ভরশীল বিকল্প হয়ে উঠেছিল থিয়েটার ক্যানভাস।
(১৯৮৪, স্বপ্নসন্ধানী)
পাশে বসে শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল আগামী দিনে আরও আরও বদলাবে ডিজিটালের দুনিয়া। সত্যি বলতে কী স্মার্টফোন আর ফোরজি টেকনোলজি আমাদের বিনোদনের জগতে যে বিস্ফোরণ এনেছে তা হেলাফেলা করার ব্যাপার নয়। কীভাবে আমাদের থিয়েটার এই দুনিয়ার সঙ্গে যুঝবে, কীভাবে আঁতাত করবে, কীভাবে প্রতিরোধ গড়বে, এ নিয়ে ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। একদিকে সোশ্যাল মিডিয়া, অন্যদিকে ওয়েবসাইট। কীভাবে দ্বিমুখী এই আক্রমণকে মোকাবিলা করা যাবে তারও লড়াই শুরু হয়ে গেছে। এবার সে সব নিয়ে একটা নীল নকশা প্রণয়নের সময় হয়ে এল।
ফেসবুক আর থিয়েটারের আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে অনেক কথা চলছে। এই তৃপ্তি মিত্রেই মাস কয়েক আগে এক সভায় নির্দেশক আশিস চট্টোপাধ্যায় বলছিলেন, আজকাল ফেসবুকেই বেশি থিয়েটার হচ্ছে। হাতে গোনা কয়েকজনের সামনে নাটক করে এমনভাবে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হচ্ছে যে দুনিয়া কেঁপে যাবে! শুধু আশিস নয়, এই কথাটা এ দেশে ও বিদেশের অনেকেই বলছেন। উষ্মার সুরে বলা হলেও এর মধ্যে একটা স্বীকৃতি আছে। সেটা হল থিয়েটার মার্কেটিং-এর হাতিয়ার হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়ার উদ্বর্তন। যে সোশ্যাল মিডিয়াকে যত ভালো করে ব্যবহার করতে পারছে সে তত সহজে তত কম খরচায় বেশি, আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। নাটকের শো হবার হপ্তাখানেক আগে থেকে ফেসবুকে প্রচার এখন দস্তুর। ফেস্টিভ্যাল, সেমিনারের বেলায় আরও আগে থেকে প্রচার চলে। কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্রের কিশোর সেনগুপ্ত একদিন বলছিলেন, গেল জুন মাসে তাঁদের দলের বার্ষিকী উৎসবের পুরো প্রচারই হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়াতে। সারা দিনে তিনটে শো। চেনাজানা ঋত্বিক সদনে নয়। প্রায় অচেনা এপিজে আবুল কালামের নামাঙ্কিত ইউনিভার্সিটি অডিটোরিয়ামে। কোনও অসুবিধে হল না। কোনও নিউজপেপার ইনসারশান, কোনও পোস্টার ব্যানার ছাড়াই সব শো হাউসফুল হয়ে গেল। উপচে পড়ে নাটক দেখল কেবল কল্যাণী নয়, দূরদূরান্তের অনেক দর্শক। গোবরডাঙ্গা নকশার আশিস দাস জানেন ফেসবুককে কীভাবে প্রচারের কাজে লাগানো যায়। নতুন নাটক ‘মুচিরাম গুড়’-এর বেলায় যা যা করণীয় করেছেন। নতুনের মধ্যে ফেসবুকের পোস্টে বা মেসেঞ্জারে এই নাটক দেখে অভিভূত দর্শকদের মন্তব্য স্ক্রিন শট সমেত পেশ করছেন। এক কাঠি চড়িয়ে লিখে দিয়েছেন, কোনও প্রিভিউ বা রিভিউ ছাড়াই তাঁদের নাটক দেখতে ভরে যাচ্ছে গোবরডাঙা সংস্কৃতি কেন্দ্র।
(কোজাগরী, বেলঘড়িয়া অভিমুখ)
নাটক দেখতে নাট্যগৃহ ভরে যাচ্ছে, সাত মণ তেল না পুড়িয়েও রাধার নাচ হচ্ছে, লাইক কমেন্ট শেয়ারের বান ডাকছে, শো শেষ হতে না হতেই নাটকের ভালোমন্দ নিয়ে খোলামেলা আলোচনার একটা আপাত গণতান্ত্রিক মঞ্চ এখন সোশ্যাল মিডিয়া–এ তো অত্যন্ত তৃপ্তিদায়ক ও স্বস্তিজনক ব্যাপার!
অস্বস্তিকর কিছু ব্যাপারও আছে। স্মার্টফোনের কারসাজিতে যাঁরা বেশি দড়, যাঁরা বুদ্ধি খাটিয়ে লোক লাগিয়ে তিলকে তাল করতে পারছেন, তাঁদের দিকে বেশি ঝোল যাচ্ছে। যাঁরা দড় নন তাঁরা খামোখা ‘পিছিয়ে পড়ছেন’। মুড়ি-মুড়কির দর অনেক সময় এক হয়ে যাচ্ছে। দর্শক যেমন উপকৃত হচ্ছেন, তেমন বিভ্রান্তও হচ্ছেন।
এখানেই কাহন বা কলকাতা ক্যানভাসের মতো ওয়েবসাইটের সদর্থক ভূমিকার বীজতলি তৈরি হয়ে যাচ্ছে। বাংলা ও ইংরিজি-জানা যে সব মানুষ কোনও না কোনওভাবে নাটকের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চান তাঁরা তো বটেই, যাঁরা সম্বন্ধ রাখেন না তাঁদেরকে কাছে টানার জন্যও এমন ওয়েবসাইটের জুড়ি মিলবে না।
এই প্রসঙ্গে মুম্বই থিয়েটার গাইড নামের একটা ওয়েবসাইটের কথা বলব। দীপা পুঞ্জানি সম্পাদিত এই ওয়েবসাইটের ভাষা ইংরিজি। তাতে কী, মুম্বই মহল্লা, পুণে, থানে, নাগপুরের মতো জায়গা, যেখানে থিয়েটার অডিটোরিয়াম আছে, যেখানে মরাঠি তো বটেই, গুজরাতি, হিন্দি, ইংরিজিতে নাটক হয়, তাদের সবার মুখপত্র এই ওয়েবসাইট। কোন হলে কবে কোন ভাষায় কোন নাটক হচ্ছে তার হাতে গরম খবর দিচ্ছে মুম্বই থিয়েটার গাইড। আমাদের মতো গ্রাহকদের মেইল বক্সে হপ্তায় একবার করে উঁকি দিচ্ছে। আমাদের কোনও খরচা হচ্ছে না। কিন্তু মুম্বইসমেত মহারাষ্ট্রের থিয়েটার হালফিল নিয়ে একটা ধারণা তৈরি হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া কেবল ফর্দ বের করা নয়, নাটক ধরে ধরে তাদের গল্পের খেই ধরাচ্ছে, কলাকুশলীদের চেনাচ্ছে, গ্রাহকদের মতামত, নাট্য সমালোচকদের মতামত-এসবও জানাচ্ছে। পারলে ছবিছাবাও বার করছে। নির্দেশকের সাক্ষাৎকার বেরোচ্ছে। আর একটা মস্ত কাজ করছে। প্রভাদেবী বা নরিম্যান পয়েন্টে নাটক দেখতে যাবার আগে টিকিট কেটে রাখার যে হ্যাপা ছিল সেটা যাতে ডিঙনো যায় সেই ব্যবস্থাও করছে। বুক মাই শো জাতের টিকিটঘরের সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছে আগ্রহী দর্শককে।
যত সহজে কথাগুলো বলা হচ্ছে অত সহজে কিন্তু কাজটা হচ্ছে না। একা তো নয়ই, একদল নাট্যমোদীকে পাশে না পেলে এ কাজ দশ-বারো বছর ধরে চালানো যেত না। যে পেশাদারিত্ব ঐ ওয়েবসাইটের তুরুপের তাস সেটা লাগাতার বের করার জন্য উপযুক্ত দক্ষিণাও চাই। সেটা আছে বলে মুম্বই থিয়েটার গাইডের কাজ সহজ হয়েছে।
আর এখানেই আমাদের মুশকিল। মহারাষ্ট্র আর পশ্চিমবঙ্গের থিয়েটার ইকনমিকসের ফারাক আসমান জমিন। একটা নাটককে প্রোমোট করার জন্য, প্রোজেক্ট করার জন্য দরকারে লাখ লাখ ঢালতে পারেন ওখানকার পেশাদার কোম্পানিগুলো। হ্যাঁ, কোম্পানিগুলো। ওখানে আমাদের মতো গণ্ডা গণ্ডা নাটকের দল নেই। আছে বেশ কিছু কোম্পানি। তাদের কেউ কেউ মুনাফার দিকে তাকিয়ে থিয়েটার করেন না। বেশির ভাগই করেন। অনেকের মুনাফার ভাগ এত বেশি যে তারা দিল্লি ফিল্লিতে কোথায় কী পাওয়া যাচ্ছে তার খবরই রাখেন না। ষোলো আনা পেশাদারদের নিয়ে ষোলো আনা পেশাদারি মনোভাব নিয়ে থিয়েটার করেন। তাদের পাশে একটা ওয়েবসাইট এসে দাঁড়ালে একটা লেনদেনের সম্পর্ক তৈরি হবে এতে আর আশ্চর্যের কী আছে।
আমাদের সিকি আনা পাইয়ের থিয়েটারে ব্যাপারটা অত সহজে হবার নয়। সেদিন তমাল বলছিলেন ‘সাস্টেনেবিলিটি’র কথা। ওটাই আসল। ওটার জন্য লজিস্টিকস চাই। ক্ষমতা, লোভ, পরশ্রীকাতরতার মতো চোরাবালি সম্পর্কে সতর্ক থাকা চাই। আমাদের দেশে, আমাদের রাজ্যে নেশার জন্য থিয়েটার করার লোক অগুনতি আছেন। তাদেরকে জুটিয়ে কাজ এগোলে ব্যাপারটা যত এগোবে, তাদের না পেলে তত পিছোবে।
তবু কাজগুলো হচ্ছে। কাহন, কলকাতা ক্যানভাসের মতো ওয়েবসাইট মূলত প্রেমের দানেই চলছে। আমাদের থিয়েটার তো প্রেমের দানেই চলে এসেছে এতকাল।
একাল যদিও অন্য অঙ্ক কষতে ওস্তাদ, তবু এমন ওয়েবসাইট আমাদের কাজে আসুক, আমরাও ওদের কাজে আসি। তাহলে সোনায় সোহাগা হবে।
(প্রচ্ছদের ছবিঃ ডন তাকে ভালো লাগে, চেতনা)
Comments are closed.