একদিন বৈঠকখানা বাজার থেকে ব্যাগ ভর্তি বাজার করে রিকশ চেপে বাড়ি ফেরা হচ্ছিল। রাস্তায় হঠাৎ দেখা এক প্রিয় মানুষের সঙ্গে। ব্যাস, অমনি প্রিয় মানুষটিকে বাড়ি নিয়ে চলে আসলেন। গিন্নী বললেন, দুপুরে ইলিশ মাছ হচ্ছে, যেন খেয়ে যাওয়া হয়। অনেক সময় ধরে গল্প চলল দুজনের মধ্যে। একজন হলেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, আর তাঁর বন্ধু মশাইটি ছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। পটলডাঙ্গা স্ট্রিটের বাড়িতে থাকতেন নারায়ণবাবু আর তাঁর প্রিয় বাজার করার জায়গাটি ছিল বৈঠকখানা বাজার, সেই জন্যই তিনি বারবার নিজের গল্পে বৈঠকখানা বাজারের কথা উল্লেখ করেছেন। তাছাড়া অনেক বাংলা সিনেমাতেও এই বাজারের উল্লেখ রয়েছে।
কিংবা যোগেশ দত্ত, বিখ্যাত মূকাভিনয় অভিনেতা। আর তাঁর পিতা শশীভূষণ দত্তের একখানা আসবাবপত্রের দোকান ছিল এই বৈঠকখানা বাজারে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটি বন্ধ হয়ে যায়।
আসলে মূল ব্যাপার হল, এই বাজারটিকে কেন্দ্র করে, বউবাজার বা হালফিলের বিপিন বিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিট থেকে শুরু করে মহাত্মা গান্ধী রোড পর্যন্ত সোজা রাস্তাটির নাম বৈঠকখানা রোড আর এই রাস্তার দক্ষিণ দিকের জায়াগাটি জুড়ে বসে বৈঠকখানা বাজার। অনেকটা জায়গা জুড়ে বসে এই বাজার।
সালটা ১৭৮৪, লেফটানেন্ট কর্নেল মার্ক উড এঁকে ফেললেন কলকাতার গোটা একটা মানচিত্র। আর সেখানেই লালবাজার থেকে পূর্বদিকে তৎকালীন মারাঠা খাত যার বর্তমান নাম অবশ্য সার্কুলার রোড ও আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু রোড। এই লালাবাজার থেকে শুরু করে মারাঠা খাত অবধি অঞ্চলটিকে মানচিত্রে ‘বয়টাকোন্না স্ট্রিট’ নামে চিহ্নিত করা হয়েছিল। কথায় আছে, এই অঞ্চলে একটা বড় বটগাছও ছিল। আবার মানচিত্রে এই বটগাছটির উল্লেখও করেছেন উড সাহেব। সেই সঙ্গে ১৭৯৪ সালে অ্যারেণ সাহেবের মানচিত্রেও বৈঠকখানা বাজারকে চিহ্নিত করা হয়েছে। চার্নক সাহেব কলকাতার গোড়াপত্তন করেন। নিজের রিপোর্টে তিনি কলকাতাকে বাণিজ্যের উপযুক্ত জায়গা হিসেবে উল্লেখ করেছেন, এটিও দেখা যায়। ইতিহাস বলছে, জোব চার্নক এই বটগাছের নীচে ছায়াতে বসে হুকো টানতেন আর বিশ্রাম নিতেন। কেই বা জানে, কলকাতাকে কীভাবে আরও সুন্দরভাবে গড়ে তুলবেন, সেটাই হয়তো তিনি ভাবতেন এখানে বসে। শুধু চার্নক সাহেব নয়, ব্যবসা করে যাঁরা বাড়ি ফিরতেন, বিশ্রাম করবেন বলে কিছুক্ষণ এই বটগাছের তলায় জিরিয়ে নিতেন, ইতিহাস সেটারও সাক্ষী রয়েছে। এই বট গাছকে কেন্দ্র করেই সেই যুগে গড়ে উঠল একটা আস্ত বাজার। অতএব এই বাজারটি যে অনেক পুরনো সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বহু যুগ ধরে বাঙালির চাহিদা পূরণ করে আসছে শিয়ালদহ-বউবাজার-কলেজ স্ট্রিট চত্বরের এই বাজারটি।
হরিসাধন মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘কলিকাতা সেকালের ও একালের’ বইটিতে যথার্থই বলেছেন, ‘লালবাজারের মোড় হইতে আরম্ভ হইয়া, এই রাস্তা বরাবর পূর্বদিকে শিয়ালদহের অভিমুখে চলিয়া গিয়াছে। আগে অর্থাৎ পলাশী আমলে এই পথের দুই ধারে বড় বড় গাছ ছিল। ইহা সেকালে Avenue to the Eastward বলিয়া পরিচিত হইত। এই পথের ধারে শিয়ালদহের নিকট ইতিহাস-প্রসিদ্ধ ‘বৈঠকখানা-বৃক্ষ।’ পূর্বে এই স্থানে একটা বৃহৎ বটগাছ ছিল। সেই বটগাছের শান্ত-শীতল ছায়াতে, নানা স্থানের ব্যবসায়ীরা, অর্থাৎ যাহারা পুরাকালের কলিকাতায় বাণিজ্যার্থে যাতায়াত করিত, মনের আনন্দে বিশ্রাম করিত। প্রবাদ আছে, কলিকাতা প্রতিষ্ঠাতা জোব চার্নকও এই বৃক্ষতলে বসিয়া, বিশ্রামকালে প্রচণ্ড রৌদ্রের সময় পাইপ টানিতেন। এ ‘বৈঠকখানা-বৃক্ষ’ বহুদিন লোপ হইয়াছে। কিন্তু বৈঠকখানা নামটি আজও বৰ্ত্তমান। লর্ড কর্ণওয়ালিসের আমলেও, এই স্থান ‘বৈঠকখানা’ বলিয়া পরিচিত ছিল।’ কিংবা বিনয় কৃষ্ণদেবের ‘The early history and growth of Calcutta’ গ্রন্থটিতেও এই বৈঠকখানা বাজারের কথা উল্লেখিত রয়েছে। অথবা হালফিলের কলকাতা পুরসভা থেকে প্রকাশিত কলকাতা পুরশ্রী (২০শে নভেম্বর, ২০১৩ প্রকাশিত সংখ্যা) নামক ম্যাগাজিনে বীরেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শিয়ালদহ–বৈঠকখানা কড়চা’ নামক ছোট্ট লেখাটি থেকে জানতে পারা যায়, এই বাজার তৎকালীন সময়ে যথেষ্ট প্রসিদ্ধ ছিল, পানের হাট, দুধের হাট, মাছের হাট, ডিমের পট্টী, কী না ছিল উনবিংশ-বিংশ শতক ধরে, অবশ্য এখনও এই সব রয়েছে এখানে। একটা সময় ছিল যখন মাটির গামলা ভর্তি করে ক্ষীর আসত বৈঠকখানা বাজারে বিক্রির জন্য। পানের হাটের আবার আয়োজন করা হত ব্রহ্মা পুজোর, আর এই পুজো উপলক্ষে বসানো হত যাত্রার আসর। যাত্রা পাড়ার নামকরা দলগুলিও আসত এখানে। ১৯৩১ সালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, কোন কোন দল এখানে যাত্রা করতে এসেছিল।
আর হবে নাই বা কেন? এতো আর যে সে বাজার নয়। সেই প্রতিষ্ঠার সময় থেকে আজ পর্যন্ত একইভাবে ক্রেতাদের রসদ সরবরাহ করছে। বাঙালির যে আবার মাছের কানকো টেনে না দেখলে বা সবজি হাতে নিয়ে না দেখলে ঠিক পেটের ভাত হজম হয় না! সেই সঙ্গে দরদাম করাটাও যে আমাদের একটা সহজাত বৈশিষ্ট্য। এই যেমন রানাঘাটের অসিতবাবু, তাঁর নিজের মুদিখানার দোকান রয়েছে, বাবার পর এখন নিজেই মালিক। বৈঠকখানা বাজারে ছোটবেলা থেকে বাবার হাত ধরে আসতেন পাইকারি দরে জিনিস কেনার জন্য। নির্দিষ্ট করে দ্রব্য সামগ্রীর তালিকা করে দোকানে দিয়ে যেতেন, আর তারপরেই সেই মাল পৌছে যেত তাঁর রানাঘাটের মুদিখানার দোকানে। আসলে এটি তো একটা বড় পাইকারি বাজারও বটে।
তাই বলে যে শুধু সাধারণ মানুষরা জিনিস কিনতে পারবেন না, ব্যাপারটা আবার সেইরকমও নয়।
এমন অনেক ব্যক্তি আছেন, যাঁরা বাড়ি ফেরার সময় এই শিয়ালদহ স্টেশন সংলগ্ন বৈঠকখানা বাজার থেকে বাজার করে নিয়ে যান। ‘সারাদিনের খাটাখাটনির পরে বাড়ি ফেরার সময় শিয়ালদহ থেকে ট্রেন ধরি, আর এই বাজার থেকে অন্তত একদিন সপ্তাহে বাজার করে বাড়ি ফিরি। আসলে এখানে দামটা অন্য জায়গার তুলনায় অনেকটাই কম, মধ্যবিত্ত পরিবার তো তাই অসুবিধা হলেও বাজারটা এখান থেকেই করে নিয়ে যাই’, জানালেন শুকদেববাবু। শুকদেব সর্দারের বাড়ি দক্ষিণ বারাসাত।
একটা বিরাট এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছে এই বাজার, কিন্তু হালফিলে বৈঠকখানা বাজার কেমন আছে?
এই তো এই বছরের জুলাই মাসের ঘটনা, একেই ভারি বর্ষণে নাজেহাল অবস্থা শহর কলকাতার। ঠিক ২২ শে জুলাই গভীর রাত্রে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল একটি বাড়ি। ঘটনাস্থলে মৃত্যু হল দুজনের, আহতের সংখ্যাও অনেক। দেড়শো বছর পুরনো এই বাড়িটি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধুঁকছিল। শুধু কি এটাই? বেশ কিছু বছর আগেও তো এই অঞ্চলে বাড়ি ভেঙে পড়ার ঘটনা ঘটেছে, তার সাথে এলাকায় সমাজবিরোধীদের দাপাদাপি। গত বছরই প্রকাশ্যে খুন করা হয়েছিল এক ব্যবসায়ীকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বললেন, এখানে শান্তি সব সময় থাকে না। দাপিয়ে বেড়ায় এলাকার দাদারা। কিন্তু প্রশ্নটা হল, এই এত বড় বাজার পৃথিবীর অন্যান্য জায়গাতে খুব কমই রয়েছে। যদি একটু রক্ষণাবেক্ষণ করে ভালোভাবে রাখা যায়, তাহলে তো আখেরে লাভ হবে ক্রেতা থেকে বিক্রেতা সকলেরই। তার সাথে দরকার নিয়মিত পরিষ্কার করা। বর্ষার সময় বাজারের অবস্থা ভয়ানক হয়ে পড়ে। তাই প্রয়োজন একটু সচেতনতা আর দায়িত্ব নিয়ে কাজ করার মানসিকতা, কারণ মধ্য কলকাতার এই বৈঠকখানা বাজার নিছক মাছ, সবজি, ধূপ, ধুনো, ঘটি, বাটি থেকে শুরু করে যা চাইবেন তাই কেনার একটা সাধারণ বাজার নয়। বৈঠকখানা বাজার কলকাতার এক ইতিহাস, যা বহন করছে ব্রিটিশ আমলের নানান ঐতিহ্য। শহরের প্রতিষ্ঠাতা জোব চার্নক থেকে শুরু করে কার পা পড়েনি এই বাজারে? এই বাজার কলকাতা তো বটেই দেশেও সম্ভবত প্রথম এক ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, যেখানে একবার ঢুকলে কোনও প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে আপনাকে আর অন্য কোথাও যেতে হবে না।
(ছবিঃ সপ্তর্ষি চৌধুরী)
Comments are closed.