আচ্ছা, হাওড়ার দাশনগর এলাকার নাম জানা আছে? হয়তো চেনা চেনা লাগছে নামটা, কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছেন না! ভাবছেন, নিশ্চই কোনও পুরনো দাশ পরিবারের নামে এই এলাকা। কিন্তু জানেন কি এই দাশ পরিবারটি সম্পর্কে কিছু?
আলামোহন দাশ ছিলেন সেই যুগের, মানে বিশ শতকের প্রথম দিকের এক অত্যন্ত উদ্যোগী, পরিশ্রমী এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ। স্বাধীনতার প্রাক্কালে নিজের একার তৎপরতায় হাওড়ার এই এলাকায় গড়ে তুলেছিলেন একের পর এক কারখানা। জুট মিল, চিনির কারখানা, ওষুধ কোম্পানি, কটন মিল, কী করলেন না? আদ্যোপান্ত ব্যবসামনস্ক আলামোহন দাশ ভোল বদলে দিলেন হাওড়ার এই এলাকার। গঙ্গার একপারে কলকাতায় যখন বসতি গড়ে উঠছে দ্রুত, অন্যপার হাওড়া তখন গড়ে উঠছে শিল্পাঞ্চল হিসেবে।
‘কিন্তু জানেন, শুরুটা খুব একটা মৃসণ ছিল না। আসলে দাদু পুরো শূন্য থেকে শুরু করেছিলেন। সেটা ১৯৩০-৪০ এর দশক। একদম প্রথমে দাদু একটা জুট মিল গড়ে তুললেন। তারপর একের পর এক বিভিন্ন কারখানা। আমাদের জাহাজও ছিল, শুনেছি দাদু নাকি এয়ারক্রাফটও কিনেছিলেন’, জানালেন জ্যোতিপ্রকাশবাবু। জ্যোতিপ্রকাশ দাশ আলামোহনবাবুর নাতি। এই দাশ পরিবারের নামেই হাওড়ার দাশনগর, যেখানে এখনও মূর্তি বসানো রয়েছে আলামোহন দাশের। স্থানীয় পুরনো মানুষজন এখনও বলেন, ঝোপঝাড় সাফ করে একের পর এক কারখানা বসিয়েছিলেন আলামোহন দাশ, প্রায় একশ বছর আগে তৈরি করেছিলেন কর্মসংস্থানের সুযোগ। তিনিই তো প্রকৃত অর্থে দাশনগরের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি এই অঞ্চলের আমুল পরিবর্তন করেন, এক সময় তিনি ভোটেও জিতেছিলেন আলামোহনবাবু। কল-কারখানা কীভাবে করতে হয়, শুধু তাই নয়, ব্যবসায়ী হিসেবে আরও বড় স্বপ্ন ছিল আলামোহন দাশের। নিজের ব্যাঙ্কও গড়ে তুলেছিলেন তিনি। যদিও দেশভাগের পর তার বেশিরভাগ শাখা বাংলাদেশে পড়ে যায়, তাই আর ব্যাঙ্ক ব্যবসা টিকিয়ে রাখা যায়নি।
এতটা পড়ে নিশ্চই ভাবছেন, হঠাৎ করে হাওড়ার দাশনগর নিয়ে লেখার কারণ কী?
আসলে হাওড়ার এই দাশ পরিবার বংশ পরম্পরায় এমন এক শখের অধিকারী, যা সচরাচর চোখে পড়ে না আজকের দিনে। সেই শখ, বা বলতে পারেন নেশার নাম শুটিং। হ্যাঁ, বন্দুক চালানো। আলামোহনবাবুর ছেলে, ছেলের স্ত্রী, নাতি, নাতনি সকলেই শুটিংয়ে সিদ্ধহস্ত। বংশ পরম্পরায় তাঁরা টিকিয়ে রেখেছেন বন্দুক চালানোর অভ্যাস।
আলামোহন দাশের মেজো ছেলে প্রভাত কুমার দাশ। ১৯৬৬ সাল, ৩৯ তম ওয়ার্ল্ড শুটিং চ্যাম্পিয়ানশিপের আসর বসেছিল জার্মানিতে। সেখানে অংশগ্রহণ করেন প্রভাত কুমার দাশ। সেই চ্যাম্পিয়ানশিপ থেকে স্কীট ইভেন্টে ব্রোঞ্জ পদক এনেছিলেন আলামোহনবাবুর মেজো ছেলে। সেই প্রতিযোগিতায় বিকানিরের মহারাজা কারনি সিংহও পদক পেয়েছিলেন। বিকানিরের রাজামশাই আর প্রভাতবাবু ছিলেন অন্তরঙ্গ বন্ধু। এমনকী প্রভাতবাবুর জন্য কারনি সিংহ নিজের শুটিং প্র্যাকটিসের অতি সংরক্ষিত স্টোর রুমটি পর্যন্ত খুলে দেন। যেখানে বিকানিরের রাজার দেশ, বিদেশের বন্দুক আর গুলির সম্ভার ছিল। প্রভাতবাবুর ছেলে জ্যোতিপ্রকাশ দাশ বললেন, ‘এই স্টোর রুমে বিকানিরের মহারাজ কাউকে ঢুকতে দিতেন না। শুধু বাবাকে বলেছিলেন নিজের মতো করে ব্যবহার করতে। আসলে বাবাকে তিনি খুব ভরসা করতেন। বাবা দিনের পর দিন বিকানিরে থেকেছিলেন সেখানকার রাজার শুটিং রেঞ্জে প্র্যাকটিস করার জন্য।’
পরে বিকানিরের রাজা কারনি সিংহ ‘From Rome to Moscow: The Memoirs of an Olympic Trap Shooter’ নামে একটি বই লেখেন। এই বইতেই তিনি প্রভাতবাবুর যথেষ্ট প্রশংসাও করেন। রাজামশাই নিশ্চিত ছিলেন, প্রভাতবাবু ১৯৬৮ সালের অলিম্পিকে গোল্ড আনবেন। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস, ১৯৬৭ সালে মারা যান তিনি। তাঁর ছেলে জ্যোতিপ্রকাশবাবু বললেন, ‘ভারতবর্ষ হারিয়েছিল এক প্রতিভাবান শুটারকে।’ শুধু বিকানিরের রাজার বইয়েই নয়, বাংলা সাহিত্যেও উল্লেখ আছে প্রভাত দাশের কথা। বুদ্ধদেব গুহ তাঁর বহু লেখায় প্রভাতের নাম উল্লেখ করেছেন। লিখেছেন, ‘প্রভাত কোনও জঙ্গলে শিকারে গেলে সেই জঙ্গলে আর তিতির পাখি থাকতো না।’ বুদ্ধদেব গুহর লেখায় এই ‘প্রভাত’ই আসলে হাওড়ার দাশ পরিবারের বিখ্যাত শুটার। ‘বাবা কলকাতার সব শুটিং ক্লাবের সদস্য ছিলেন। আমাদের নিজেদের একটা গোটা শুটিং রেঞ্জ ছিল দাশনগরে, যেটা বাবা তৈরি করেছিলেন। এখন অবশ্য সেটার আর অস্তিত্ব নেই। আসলে বাবা যে শুধু শুটিংয়ে পারদর্শী ছিলেন তা নয়। বাবা ছিলেন একজন টোটাল স্পোর্টসম্যান। ক্রিকেট থেকে শুরু করে টেনিস, দাবা, তাস, এমনকী ডাঙ্গুলি, সব খেলায় সেরা ছিলেন বাবা।’ জানালেন তাঁর ছেলে। ‘জানেন, বাবা খুব ভাল ঘুড়ি ওড়াতেন। এসএন ব্যানার্জি রোডে আমার মামার বাড়ি। প্রতি বিশ্বকর্মা পুজোতে আমরা পুরো পরিবার মামা বাড়ি যেতাম, বাবার ঘুড়ি ও মাঞ্জা আসত মেটিয়াবুরুজ থেকে।’ বলতে বলতে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন জ্যোতিপ্রকাশবাবু। বললেন, ‘আমার মাও শুটিং করতেন। তবে পেশাদার নন, নেহাতই শখে।
প্রভাত কুমার দাশের উত্তরাধিকার সযত্নে ধরে রেখেছেন তাঁর ছেলে জ্যোতিপ্রকাশবাবু ও মেয়ে মৌসুমি দাশ। বলা যায়, বাবার ট্র্যাডিশন তাঁর দুই ছেলে-মেয়ে পালন করে চলেছেন। মৌসুমী দাশ নিজে ইন্টারন্যাশনাল শুটার। মৌসুমিদেবী এখন অবশ্য জার্মানিতে বসবাস করেন। ১৯৯১ সালে মস্কোর ওয়ার্ল্ড শুটিং চ্যাম্পিয়ানশিপে মৌসুমিদেবী অংশ নেন। তাছাড়াও বিদেশের বহু প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন তিনি। এশিয়ান গেমস, সাফ গেমস, ওয়ার্ল্ড কাপেও নেমেছিলেন মৌসুমি। মৌসুমির ইভেন্ট ছিল .২২ রাইফেল, প্রোন (৫০ মিটার)। তাছাড়াও ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে নেমেছিলেন তিনি। বিদেশের একাধিক শুটিং অর্গানাইজেশনের সদস্যপদ পেয়েছেন মৌসুমি। ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশন গোল্ডেন ইগল, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশন অফ আমেরিকা তাঁকে সম্মানিত করে সদস্যপদ দিয়েছে। বোনের মতো জ্যোতিপ্রকাশবাবু নিজেও একাধিকবার দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বহু প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন।
‘আসলে শুটিং আমাদের রক্তে’, বাবার সেই ১৯৬৬ সালের ব্রোঞ্জের পদকটা উপর ধুলোর আস্তরণ সরাতে সরাতে বলছিলেন জ্যোতি প্রকাশ দাশ। বাবার সেই সব বন্দুক এখনও আমাদের কাছে অমূল্য স্মৃতি। রাইফেল, পিস্তল কী নেই? ১৯৬২ সালের গুলিও রয়েছে, ওই লটের গুলি নাকি আজও পর্যন্ত বেস্ট। তাছাড়াও দেশ বিদেশের বিখ্যাত সব প্রতিযোগিতায় পাওয়া মেডেল সাজিয়ে রেখেছেন জ্যোতিপ্রকাশবাবু। তিনি এখনও নিজে শুটিং করেন। সাউথ ক্যালকাটা রাইফেল ক্লাবের সদস্য জ্যোতিপ্রকাশবাবু নিজে শুটিংয়ের পাশাপাশি সেখানকার কোচও বটে। নিয়ম করে এখনও কোচিং করান তিনি।
জ্যোতিপ্রকাশবাবু বললেন, ‘এই শুটিংয়ের শখ এখন কিন্তু আস্তে আস্তে কমে আসছে। আমাদের মতো দেশে এরকম এক্সপেন্সিভ স্পোর্টস জনপ্রিয় হওয়া কঠিন। শুটিং করতে অনেক টাকার দরকার। প্রতিভা থাকলেও টাকার অভাবে অনেকে এই খেলা থেকে মুখ ফিরিয়েছে। একটা ভালো মানের গুলির দামই তো প্রচুর।’ তবে তা সত্ত্বেও এই দাশ পরিবার এখনও বংশ পরম্পরায় শুটিং চালিয়ে আসছেন, কিন্তু পরবর্তী প্রজন্ম সেই ঐতিহ্য বহন করবে তো, তাই ভাবায় জ্যোতিপ্রকাশবাবুকে।
ছবিঃ সপ্তর্ষি চৌধুরী
Comments are closed.