এশিয়ার সবচেয়ে বড় খেলাধুলোর সরঞ্জামের বাজার ময়দান মার্কেট সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চালু করল অনলাইন শপিং
একটা সময় ছিল যখন এসপ্লানেড চত্বরে অস্থায়ী হকারদের বসার জন্য তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী ডঃ বিধানচন্দ্র রায় একটি পাকাপোক্ত বাজার করে দিয়েছিলেন, যেখানে মাসিক ২০ টাকার বিনিময়ে দোকান ভাড়া দেওয়া হয়। তখন এই বাজারের নাম দেওয়া হয়েছিল হকার্স মার্কেট। এরপর অবশ্য সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন ১৯৭২ সাল নাগাদ নতুন করে গোড়া তোলা হল এই বাজার, যার নাম দেওয়া হল ডঃ বিধানচন্দ্র রায় মার্কেট, চলতি কথায় যাকে আমরা ময়দান মার্কেট বলে থাকি। তথ্য বলে, এশিয়ার মধ্যে নাকি এই বাজার খেলাধুলোর জিনিসের বৃহত্তম মার্কেট। থাইল্যান্ডেও এরকম একটি স্পোর্টস মার্কেট আছে বটে, তবে সেখানে একটা ছাদের তলায় খুব বড়জোর ৪০-৫০ টি দোকান। আর ময়দান মার্কেটে দোকান ৪০০ র বেশি।
আসলে ইতিহাস বা তথ্য যাই বলুক না কেন! এই বাজার যে খেলা পাগল বাঙালিকে অক্সিজেন জোগায়, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। চুটিয়ে খেলাধুলো করেছেন অথচ ময়দান মার্কেটে পা ফেলেননি, এরকম বাঙালির দেখা মেলা ভার। কী চান আপনি? মানে, কোন খেলার সরজ্ঞাম? সব রকম খেলার সরজ্ঞাম নিয়ে এখানে বসে আছেন দোকানিরা। ক্রিকেট, ফুটবল, টেনিস, ভলিবল, ক্যারম, বডি বিল্ডিং এর সরজ্ঞাম, শিল্ড, মেডেল, ট্রফি সবই বিক্রি হচ্ছে এক ছাদের তলায়। স্থানীয় সরজ্ঞাম ছাড়াও যে কোনও নামী দামি ব্র্যান্ডও আপনি পেয়ে যাবেন এখানে। কিংবা জার্সি! দেশ বিদেশ ছাড়াও একাধিক ক্লাবের জার্সির ব্যাপক কালেকশান আপনাকে তাক লাগিয়ে দেবে, যা নিঃসন্দেহে হার মানাবে যে কোন অনলাইন শপিং পোর্টালকে। আর অনলাইন কেনা কাটার প্রশ্নতেও কিন্তু ময়দান মার্কেট পিছিয়ে নেই। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ময়দান মার্কেটের পক্ষ থেকে খোলা হয়েছে নিজেদের ওয়েবসাইটও, যেখানে আপনি অর্ডার করলে আপনার বাড়িতে পৌঁছে যাবে জিনিসটি, যা কিনা আমাদের অনেকেরই জানার বাইরে। অনলাইন বিক্রির সব সুবিধা রয়েছে এই ওয়েবসাইটে। (http://marketmaidan.in/)
আসলে চলতি ভাষায় ময়দান মার্কেট বলা হয়, কারণ আশেপাশ জুড়ে যে বিস্তীর্ন মাঠ ময়দান বিরাজমান, সেখান থেকেই এর নাম এসেছে। কলকাতা মাঠের ক্লাবে নিয়মিত যাঁরা খেলতেন তাঁদের পছন্দের জায়গা এই মার্কেট। একটা সময় ভারতবর্ষজুড়ে ফুটবল মাঠ কাঁপানো ফুটবলার পি কে ব্যানার্জি, চুনী গোস্বামী, গৌতম সরকার, সুভাষ ভৌমিকরা তো এখান থেকেই কিট কিনতেন। সেই সময় আবার নাগরাজের স্পাইক ছিল নামকরা। আবার পরবর্তী প্রজন্মের কাছে জ্যাকিদা’র দোকান ছিল মারাত্মক পছন্দের। সেই জ্যাকিদা এখন আর বেঁচে নেই।
ময়দান মার্কেট নিয়ে কথা হবে, অথচ কৈলাসদা’র নাম আসবে না সেটা তো হতে পারে না। খেলতে গিয়ে বুট ছিঁড়ে গেছে অথবা ফুটবলের সেলাই কেটে গেছে। সারাই করার জন্য খেলোয়াড়রা বারবার ছুটে এসেছেন কৈলাসদার কাছে। প্রায় ৪০–৫০ বছর ধরে এই কাজে রয়েছেন তিনি। এখনও যাকে লোকে একনামে চেনেন। নিজের বয়স যখন ১২ তখন থেকে এই কাজে, আর এখন ৬০ এর বেশি।
ছোটবেলায় নিজে ডিভিশন খেলেছেন, ময়দান মার্কেট চষে ফেলা। ক্রিকেট, ফুটবল কোনটাই বাদ রাখেননি। বছর ৫৫ এর সুবীর চৌধুরী জানালেন, ‘ক্রিকেটের কিট কিংবা ফুটবলের জুতো কেনার জন্য ছুটে আসতাম, প্র্যাকটিসের পর ময়দান মার্কেট একবার ঢুঁ না মারলে কীরকম একটা যেন হোত। আর এখনকার মতো আমাদের সময় পাড়ায় পাড়ায় জিম ছিল না, একমাত্র ভরসা ছিল আমাদের ক্লাবের জিম অথবা ডাম্বেল কেনা। সেটাও তো এখান থেকেই নিতাম। এখন আসি মাঝে মধ্যে। তবে নিজের জন্য না, ছেলেটাকে ক্রিকেট শেখাতে দিয়েছি তো, ওর কিট কিনতে। আমার কাছে এই মার্কেট একটা ভরসা জোগায়।’
রুবেলের বজবজ থেকে প্রতিদিন ট্রেনে করে ময়দান আসা হয় ফুটবল প্র্যাকটিসের জন্য। রুবেলের স্বপ্ন, একদিন বড় ক্লাবের জার্সি গায়ে দেওয়া। আর ময়দান মার্কেট প্রশ্নে তাঁর জবাব, ‘এখানে একবার না আসলে ঠিক হয় না। যতই অনলাইন হোক না কেন, নিজে হাতে ধরে খেলার বুট না কিনলে হয় নাকি!
১৯৯০ এর দশকে গড়ে উঠেছিল কাজি স্পোর্টস। ‘আসলে আমার দোকানটায় ফিটনেসের সরজ্ঞাম রয়েছে। অনলাইন দুনিয়াটা একটু হলেও বেগ দিয়েছে, আর আমার দোকানে যা যা পাওয়া যায় সেগুলোর তো অনলাইন দুনিয়াতে রমরমা ব্যাপার। অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসা সামলানো মুশকিল হয়ে যাচ্ছে’, জানালেন দোকানের মালিক কাজি আরশেখ আলি।
কিন্তু ভিন্ন মত আরশাদ হুসেনের। তাঁর মতে, যতই অনলাইন কেনাকাটা হোক না কেন, যাঁরা ময়দান মার্কেটে আসার, তাঁরা এখনও ঠিক আসেন। খেলাধুলোর জিনিস তো আর ছবি দেখে কেনা যায় না। এটা কেনার জন্য হাতে দেখে পরখ করতে হয়। আরশাদ বেশ কয়েক বছর ধরে টি এম স্পোর্টস নামক দোকানে কাজ করেন।
‘যখন প্রথম এই মার্কেট শুরু হয় তখন ৮০ শতাংশই ছিল মেয়েদের জামা কাপড়ের দোকান, আর ২০ শতাংশ ছিল স্পোর্টসের দোকান। আর এখন ছবিটা পুরো উল্টো, ৮০ শতাংশই স্পোর্টস শপ। আর বাঙালির রক্তে তো খেলাধুলো, তাই চাহিদা অনুযায়ী এই পরিবর্তন। এই দেখুন না, আমাদের দেশ তো কোনও দিন ফুটবল বিশ্বকাপ খেলেনি, কিন্তু এই যে বিশ্বকাপ হয়ে গেল তাতে যে কী হারে জার্সি বিক্রি হয়েছে কল্পনা করতে পারবেন না। আমাদের ময়দানের বড় ক্লাবের জার্সির চাহিদাও কিন্তু কম না। আর তাছাড়া ইন্ডিয়া ক্রিকেট দলের জার্সি তো আছেই। যতই অলনাইন আসুক না কেন, আমাদের এখানে ১২ মাসই বেচা-কেনা চলে’, বললেন রিলায়েবেল স্পোর্টসের মালিক সুজিত কুমার শুক্লা। সেই সঙ্গে জানালেন, ‘আজকাল আমরা কয়েকটা সমস্যার মধ্যে রয়েছি। এই ময়দান মার্কেটের জমিটা একেই সেনার অধীনে, আবার ওইদিকে নতুন করে মেট্রো রেলের কাজ চলছে। কখন যে আমাদের তুলে দেবে সেটা জানা নেই। মার্কেট যদি তুলে দেওয়া হয় কত পরিবার পথে বসবে তা চিন্তার বাইরে। এটা তো পাইকারি মার্কেটও, জেলা থেকে কত লোক আসেন এখানে পাইকারি দরে জিনিস কিনতে।’
কিন্তু প্রশ্ন হল, মার্কেটের বর্তমান পরিস্থিতি। অনেক জায়গাতেই সংস্কার প্রয়োজন। প্রায় ৪০০ দোকান, কিন্তু নিরাপত্তার লেশমাত্র নেই। অন্যদিকে, সরকারের পক্ষ থেকেও সেরকম কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। রাত্রিবেলা অন্তত হাজার খানেক মানুষ থাকেন এই মার্কেটের ভিতরে, কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে যে মারাত্মক হতে পারে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কলকাতার পুরনো মার্কেটগুলোতে যেভাবে মাঝে মধ্যেই আগুন ধরে, সংস্কারের অভাবে এখানে যে দুর্ঘটনা ঘটবে না, সেটা কেই বা বলতে পারে! সেই আশঙ্কাতেই খানিকটা শঙ্কিত দোকানিরা।
Comments are closed.