খিদের জ্বালায় অন্ধ্রে মাটি খেয়ে ২ বছরের শিশুর মৃত্যু বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে ১১৯ দেশের মধ্যে ১০৩ নম্বরে ভারত
খবর ১
জেট গতিতে এগোচ্ছে দেশের অর্থনীতি। আশা করা হচ্ছে, আর কিছুদিনের মধ্যেই উন্নত অর্থনীতির এলিট তালিকায় ঢুকে পড়বে ভারত।
খবর ২
অন্ধ্র প্রদেশে খিদের জ্বালায় মাটি খেয়ে মৃত্যু ২ বছরের ভেনেল্লার।
এই দুটি খবরকে এক সূত্রে মেলানো যায় কি? উত্তরটা হল, যায় না। ভারতের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সুফল মাটি পর্যন্ত পৌঁছচ্ছে কিনা, ভেনেল্লাই যে তাঁর জ্বলন্ত উদাহরণ। ভেনেল্লা কি ভারতের মতো দেশে বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা?
গত শনিবার অন্ধ্র প্রদেশে খিদের জ্বালায় ছটফট করতে করতে মাটি খেয়ে ফেলে ২ বছরের ভেনেল্লা। তারপর তাঁর মৃত্যু হয়। বিরোধীরা ক্ষমতাসীনের দিকে অবহেলার অভিযোগ করে, অন্যদিকে মৃত্যুর কারণ যে অনাহার নয় বরং শারীরিক অসুস্থতা, তা জোর দিয়ে প্রচার করে ক্ষমতাসীন। সরকার বদলায়, কিন্তু মনোভাব বদলায় না। সরকারে যেই থাক, অনাহারে মৃত্যুর দাবি মানার প্রশ্নই নেই।
এই প্রেক্ষাপটেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ২০১৮ সালের গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সের সর্বশেষ রিপোর্ট। যে রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ১১৯ টি অংশগ্রহণকারী দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০৩। ভারতের পিছনে রয়েছে কেবলমাত্র সুদান, সিয়েরা লিওন, জ়াম্বিয়া, মাডাগাস্কার, চাদ এবং সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকের মতো সাব সাহারান দেশগুলি। ভারতের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ছাড়ছে পাকিস্তান, আফগানিস্থানের মতো দেশগুলি।
সম্প্রতি ইউনিসেফের রিপোর্টে উঠে এসেছে, ভারতে ৫ বছরের কম বয়সী যত বাচ্চার মৃত্যু হয়, তার অর্ধেকের বেশি মৃত্যুর কারণ অপুষ্টি। যদিও মৃত্যুর চূড়ান্ত কারণ হিসেবে অনাহার কিংবা খিদের বদলে উল্লেখ করা হয় ডায়েরিয়া কিংবা নিউমোনিয়ার কথা। শিশু নিত্য অনাহারে এতটাই রুগ্ন হয়ে পড়ে যে তার শরীর সামান্য কোনও অসুস্থতাতেই কাহিল হয়ে পড়ে এবং তার মৃত্যু হয়। প্রকৃতপক্ষে, অনাহার বা অপুষ্টিতেই মৃত্যু হয় শিশুর।
গত বছরের জুলাই মাসে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি উত্তর সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে উঠে এসেছে একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের অধ্যাপক বিক্রম প্যাটেল তাঁর প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে, দেশে বছরে ১৫ লক্ষেরও বেশি শিশুর মৃত্যু হয়, অর্থাৎ প্রতিদিন প্রায় ৪,৫০০ শিশু প্রাণ হারাচ্ছে। বিক্রম প্যাটেলের বিশ্লেষণ, শিশুদের দিনের পর দিন খালি পেটে রাতে শুতে না পাঠানো গেলেই, এই বিপুল পরিমাণ শিশু মৃত্যুর অন্তত এক তৃতীয়াংশ কমিয়ে ফেলা সম্ভব হবে। অর্থাৎ, স্রেফ খিদের জ্বালায় বছরে দেশে ৫ লক্ষ শিশুর মৃত্যু হচ্ছে, প্রতিদিনের হিসেবে প্রায় ১৪০০ জন। বিক্রম প্যাটেল আরও বলছেন, যে শিশুরা বেঁচে গেল, তাদেরও ভবিষ্যত খুব একটা সুরক্ষিত নয়। তাঁর মতে, খিদের জ্বালা শিশুকে মৃ্ত্যুর মুখে ঠেলে না দিলেও, তা সরাসরি প্রভাব বিস্তার করে তার স্বাস্থ্য এবং মস্তিষ্কের ওপর। যে প্রভাব থেকে জীবদ্দশায় বেরোতে পারে না তারা। ফল, শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে ব্যাঘাত। দারিদ্রের ফাঁদ কেটে বেরোতে পারে না তাদের সিংহভাগই। সংখ্যাতত্ত্ব বলছে, ছেলেবেলায় অনাহারে থাকা মানুষদের জীবনকালও হয় যথেষ্ট কম।
একটা জিনিস পরিষ্কার, অন্ধ্র প্রদেশে ২ বছরের ভেনেল্লার মাটি খেয়ে মৃত্যু কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এই প্রেক্ষিতেই প্রশ্ন উঠছে, যে দেশে প্রতিদিন ৮২২ জন শিশুর মৃত্যু হচ্ছে স্রেফ অনাহার এবং খিদের জ্বালায়, অর্থনৈতিকভাবে সেই দেশ কত উন্নতি করল, তার কোনও অর্থ থাকে কি? আমাদের দেশ খাদ্যে স্বয়ম্ভর। পরিস্থিতি এমনই যে উদ্বৃত্ত শস্য পচে নষ্ট হওয়া কিংবা ইঁদুরে খেয়ে ফেলার ঘটনাও বিরল নয়। কিন্তু পেট সম্পূর্ণ খালি দেশের শিশুদের একটা বিরাট অংশের। যে কোনও দেশের ভবিষ্যত তাদের সন্তানরা। কিন্তু উন্নত ভারতের কাণ্ডারিরা জানেন কি, প্রতিদিন অনাহারে থাকতে থাকতে মরিয়া ভেনেল্লারা কেন মাটিকেই খাবার ভেবে মুখে তোলে?
Comments are closed.