করোনা মোকাবিলা: সরকারি দায়িত্বে থাকলে এখন কী করতেন? অভিজিৎকে প্রশ্ন স্ত্রী এস্থারের! করোনার প্রভাব কী, জানতে চাইলেন স্বামী! কথোপকথনে নোবেলজয়ী দম্পতি
করোনাভাইরাসের কেমন প্রভাব পড়তে চলেছে বিশ্ব অর্থনীতিতে, ভারতেই বা ভবিষ্যতের ছবিটা কেমন হতে চলেছে, Juggernut Books ও scroll.in আয়োজিত Read Insted online litfest অনুষ্ঠানে দীর্ঘ আলোচনা করলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ দম্পতি অভিজিৎ বিনায়ক ব্যনার্জি ও এস্থার ডুফলো। ৩ এপ্রিল ইউটিউবে প্রকাশিত এই সাক্ষাৎকারে কী কী আলোচনা করলেন বিশ্বের দুই অন্যতম সেরা অর্থনীতিবিদ?
প্রায় ২৪ মিনিটের এই আলোচনার শেষভাগে অর্থনীতিবিদ দম্পতি বিশ্ব অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব বিশ্লেষণ করতে গিয়ে রীতিমতো উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এস্থার ডুফলো বলেন, বর্তমান সময়ে জীবন আর জীবিকায় একটা তীব্র সংঘাত হচ্ছে। এটা তাঁর কাছে ভীষণ পীড়াদায়ক। এর প্রতিক্রিয়ায় অভিজিৎ বিনায়ক জানান, তাঁর মনে যে সংঘাত কাজ করছে তা হল, মানুষ অনির্দিষ্ট কালের জন্য এই বাড়িবন্দি জীবন মেনে নেবে না। সে সরকার বিনা পয়সায় রেশনে যতই চাল-গম দিক, ছ’মাস ধরে বিনা পয়সায় খাবার দিলেও মানুষ তা গ্রহণ করবে না বলে মত অভিজিতের। তিনি বলেন, মানুষ আসলে এর চেয়ে ভাল জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত।
তাঁর মতে, লকডাউন হয়েছে অল্প সময়ের জন্য, এবং সেটাই বাস্তবসম্মত। আশা করা যায়, এর ফলে সংক্রমণ ছড়ানোর গতি কিছুটা কমবে। তারপর মানুষকে মুক্তি দিতে হবে। এর মধ্যে আরও পরিকল্পনা করতে হবে সরকারকে। অভিজিতের আন্দাজ, মাস ছয়েক এই যুদ্ধ চলবে, হয়ত খুব বেশি প্রাণক্ষয় হবে না। কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতির পতন হবে। ধনী দেশগুলো বাইরে থেকে কেনা বন্ধ করে দেবে, এটা একদম পরিষ্কার। তিনি বলেন, আমরা এক বিপুল মন্দা দেখব। কারও মনে হতে পারে, এটা কি মন্দা? ধনী তো তার আয় হারাচ্ছে না, মধ্যবিত্ত বাড়ি হারাচ্ছে না! সবাই ভাববে কিছু দিন একটু ঢিলে যাবে তারপর লোকে আবার কেনা শুরু করবে। কিন্তু মনে হয় এই সম্ভাবনা ক্রমশ ক্ষীণ হচ্ছে।
অভিজিৎ বলেন, শেয়ার বাজারে ধস নেমেছে, মধ্যবিত্তের আয় কমেছে। এই সময়ের পরে ক্রেতারা উৎসাহের সঙ্গে জিনিসপত্র কিনবে, সে আশাও কম। তাই আমাদের প্রয়োজন এমন নীতি, যা এই ব্যবস্থাটাকে চালু রাখবে। চাহিদাকে ফের চাঙ্গা করবে। কারণ, মানুষের আয় এতটাই কমবে, যে সম্পদ তারা হারাবে, তাতে হাতে যা থাকবে সেটা আর তারা খরচ করতে চাইবে না। এটাই হল অর্থনীতির প্রধান উদ্বেগ।
অভিজিৎ বিনায়ক বলতে থাকেন, এটা কি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের পরিস্থিতি হবে? যখন মানুষ নয়া উদ্যমে কেনাকাটা করবে, না কি ২০০৯ সালের সঙ্কট চলাকালীন পরিস্থিতি তৈরি হবে যখন, মানুষ খরচ করতে ভয় পাবে? এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই। এ ব্যাপারে তিনি আশাবাদী নন, বরং ভীত বলে স্ত্রী এস্থারকে জানান অভিজিৎ।
বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে বড় সমস্যা কী এবং করোনার প্রভাবে ভবিষ্যতে কোন সমস্যা গভীর হতে চলেছে, সাক্ষাৎকারের প্রথম দিকে স্ত্রী এস্থারের উদ্দেশে প্রশ্ন করেন অভিজিৎ।
এস্থার ডুফলোর কথায়, এখন বৃহত্তম সমস্যা হল, মানুষের জীবন রক্ষা। আর অদূর ভবিষ্যতে যে সমস্যা বড় হয়ে দেখা দেবে তা হল, বিপুল সংখ্যক মানুষের কাজ ফেরানো, স্বাভাবিক অর্থনীতিতে ফিরে যাওয়া। এস্থারের কথায়, আমরা প্রাণ বাঁচাতে যা করছি, তার কারণেই ভবিষ্যতে যাতে জীবিকা খুইয়ে না যায়, তা দেখা দরকার। অতঃপর, এর সমাধান কী? কী করা উচিত বলে মনে হচ্ছে? স্ত্রী এস্থারকে ফের প্রশ্ন করেন অভিজিৎ। উত্তরে এস্থার জানান, বর্তমানে আমাদের ডাক্তারের পরামর্শ মতো চলতে হবে, তাঁরা কী বলছেন তা বোঝার চেষ্টা করতে হবে। এস্থারের কথায়, পরিস্থিতি যে খারাপ তা সবাই জানি। নিরাময়ের উপায় খোঁজার চেষ্টা চলছে, তা পেতে বেশ সময় লাগবে। এখন একটাই উপায়, তা হল, নিজেদের আলাদা রাখা, বারবার হাত ধোয়া, পরিচ্ছন্ন থাকা। যাতে সংক্রমিত লোকের সংস্পর্শে এলেও করোনা না ছড়ায় তা দেখতে হবে।
কিন্তু দূরত্ব বজায় রেখে, সেল্ফ আইসোলেশনে দীর্ঘদিন থাকা কতটা সম্ভব? এভাবে কতদিন দিন চলবে? মানুষের রোজগার বন্ধ, বাইরে বেরনো বন্ধ। ছ’মাস ধরে এমন চলবে, তা ধরে নেওয়া কি বাস্তবসম্মত? অভিজিৎ বিনায়কের কঠিন ও বাস্তবিক প্রশ্নের মুখে এস্থারেরও মত, এভাবে দু’ সপ্তাহ চালানোই মুশকিল। তিনি অভিজিৎকে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করেন, তিনি যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিশেষ দায়িত্বে থাকতেন, তা হলে কবে থেকে এই কারফিউ শুরু করতেন?
অভিজিৎ মেনে নেন এটা কঠিন প্রশ্ন। তাঁর পাঁচ মাস সম্পূর্ণ ঘরবন্দির কথা ভাবতেই ভয় লাগে। তবু মানুষের প্রাণ রক্ষার জন্য এই সিদ্ধান্ত নিতেই হত। অভিজিৎ বলেন, ক্ষমতায় থাকলে কী সিদ্ধান্ত নিতাম বলা মুশকিল, কারণ তাতে কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যে কিছু লোককে মারা যেতে দিতে হবে। আবার, মানুষকে বাড়িতে বসিয়ে রাখার, সব কিছু বন্ধ রাখার জন্য চাপ তৈরি করলে পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকবে। পাঁচ মাস সব কিছু বন্ধ থাকলে মানুষের ধারণাই হবে, কেন্দ্র আদতে আর কাজ করছে না। এক দিকে মানুষের প্রাণ বাঁচানো, আর অন্য দিকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে যে বিপুল প্রশাসনিক ব্যয় ও অর্থনীতির প্রবল ক্ষতি, এই দুটোর কোনও একটার দিকে ভার বেশি হবেই। প্রাণ বাঁচানোর কাজে একটু খারাপ করলে অর্থনীতিকে বাঁচানোর কাজটা হয়তো একটু সহজ হতে পারে, মত নোবেলজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদের।
পাশাপাশি স্ত্রী এস্থারের আর এক প্রশ্নের উত্তরে অভিজিৎ এও জানান, করোনায় আসল সংক্রমিতের সংখ্যা পাওয়াই কঠিন। নির্দিষ্ট ভাবে কত জনের মৃত্যু হচ্ছে তা হিসেবের উপায় নেই। তাঁর কথায়, ফ্রান্সে কেউ বাড়িতে মারা গেলে তাঁকে তো সংক্রমণে মৃতদের মধ্যে গণ্য করা হয় না। একমাত্র হাসপাতালে মারা গেলে তবেই হিসেব করা হয় করোনায় কত জন মারা গেলেন। আর ভারতের ক্ষেত্রে বৃদ্ধদের রোগ হয়ত নির্ণয় করা যাবে না।অভিজিৎ বলেন, এ দেশে যাঁরা গুরুতর অসুস্থ, তাঁদের কথাই যদি ধরা হয়, ভারতের মতো বিরাট দেশে সেটার মানেই লক্ষ লক্ষ মানুষ। তার মধ্যে কে আক্রান্ত সেটা বোঝা শক্ত। তাছাড়া গরম, আর্দ্রতার সময় এই অসুখ কোন দিকে যাবে, তা এখনই জানা যাচ্ছে না।
Comments are closed.