‘সবার ওপরে সংগঠন সত্য, তাহার ওপরে নাই’, ভোটের রাজনীতিতে এই মিথ ভাঙার কঠিনতম লড়াইয়ে অধীর চৌধুরীর পুঁজি, মমতা বিরোধিতা

দেড়শো বছরেরও বেশি সময় আগে বহরমপুরের সেনা বারাক সিপাহী বিদ্রোহ দেখেছে। আর আজ রাজ্যে কংগ্রেসের শেষ দুর্গ রক্ষা করার কঠিনতম লড়াইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে অধীররঞ্জন চৌধুরী দু’বছর ধরে দেখছেন, তাঁর হাতের তালুর মতো চেনা বহরমপুরে কংগ্রেস নেতাদের বিদ্রোহ। তাঁর একদা ঘনিষ্ঠ অপূর্ব সরকারই তাঁর বিরুদ্ধে লড়ছেন আজ। তাঁর একদা ঘনিষ্ঠ আবু তাহের পাশের কেন্দ্র মুর্শিদাবাদের প্রার্থী। তাঁর স্নেহ, প্রশ্রয়ে বেড়ে ওঠা একের পর এক কংগ্রেস কর্মী আজ তৃণমূলের জার্সি পরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন বেলডাঙা থেকে ভরতপুর, কান্দি থেকে নওদা।
আসলে ২৯ শে এপ্রিল চতুর্থ দফার ভোটে বহরমপুর কেন্দ্রে লড়াই শুধুমাত্র তৃণমূল এবং সিপিএম সমর্থিত কংগ্রেসের মধ্যে নয়, এ লড়াই এক বহু পুরনো যুক্তি এবং পাল্টা যুক্তির মধ্যে কোনটা ঠিক, তার পরীক্ষা।
তো কী সেই যুক্তি-পাল্টা যুক্তি?
একদিকে সংগঠন, উল্টোদিকে ব্যক্তি। ভোটের লড়াইয়ে শেষ বাজিমাত করে কে, এ রাজ্যে এবারের ভোটে একমাত্র জলজ্যান্ত ল্যাবরেটরির নাম বহরমপুর।
২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল সরকার গঠনের পরই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পাখির চোখ করেছিলেন মালদহ, মুর্শিদাবাদ। এবং এই দুই জেলা উদ্ধারে দায়িত্ব দিয়েছিলেন শুভেন্দু অধিকারীকে। শুভেন্দু রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতায় জানতেন, শুধুমাত্র তাঁর পদবী বা কাঁথিতে পরিবারের পরিচয়ই যথেষ্ট নয় গ্রাম বাংলার ভোটে জেতার জন্য। ২০০১ বিধানসভা ভোটে পূর্ব মেদিনীপুরের মুগবেড়িয়া কেন্দ্রে কিরণময় নন্দ এবং ২০০৪ লোকসভায় তমলুক কেন্দ্রে লক্ষ্মণ শেঠের কাছে হারের অভিজ্ঞতা তাঁকে এই শিক্ষাই দিয়েছিল, এ রাজ্যে ভোটে জিততে গেলে প্রথম দরকার সংগঠন। দ্বিতীয়ত দরকার সংগঠন এবং তিন নম্বর থেকে শুরু হয় অন্যান্য ফ্যাক্টর।
আর তাই মুর্শিদাবাদ জেলার দায়িত্ব নিয়েই পঞ্চায়েত দখলের লক্ষ্যে মরিয়া হয়ে উঠলেন তিনি। একদিকে কংগ্রেসের বিধায়করা যেমন যোগ দিতে শুরু করলেন তৃণমূলে, তেমনই পুরসভা থেকে জেলা পরিষদ সবই কার্যত অল্প বাধায় চলে এল তৃণমূলের দিকে। সেই আবহেই ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোট এবং বহরমপুর কেন্দ্রের সাতটি বিধানসভা মিলে ১০৪ টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ৯৮ টি দখল করে নিল তৃণমূল। বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রের প্রায় ৮০ শতাংশ ভোটারই এই পঞ্চায়েতের বাসিন্দা। পঞ্চায়েত ভোটের আগে থেকেই জেলার রাজনীতিতে পোড় খাওয়া অধীর বুঝতে পারছিলেন, তাঁর সাজানো বাগান লণ্ডভণ্ড হওয়ার পথে। গ্রামের পঞ্চায়েত হাতে নেই, বিধায়ক সঙ্গে নেই, জীবনের কঠিনতম লড়াইয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছেন তিনি।
বহরমপুরে ২৯ শে এপ্রিলের ভোটে তৃণমূলের মূল অস্ত্র যদি হয় পঞ্চায়েতের ক্ষমতা দখল এবং তার মধ্যে দিয়ে গ্রামের প্রতিটি বুথে লোকবল থেকে প্রভাব সব কিছুতে এগিয়ে থাকা, তবুও ব্যাপারটা এত সরল এবং একমাত্রিক নয় যে, শুধু তা দিয়েই অধীর সাম্রাজ্য খুব সহজে ভেঙে দেওয়া যাবে। আর এটা সবচেয়ে ভালো জানেন শুভেন্দু অধিকারী নিজেও।
অধীর চৌধুরীর প্রধান পাঁচটি শক্তিকে এক কথায় লিখতে গেলে এক থেকে তিন পর্যন্ত লিখতে হবে, ‘তাঁর আপোষহীন মমতা বিরোধিতা’। চার নম্বরে বহরমপুরে তাঁর ইমেজ এবং পাঁচে সিপিএম-বিজেপির সমর্থন।
১৯৯৮ সালের পর থেকে শুধু এ রাজ্য নয়, গোটা দেশে যদি একজন মাত্র কংগ্রেসি নেতা আজ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে, বিশ্বাসযোগ্যভাবে সমস্ত ইস্যুতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতা করে গিয়েছেন, তাঁর নাম অধীররঞ্জন চৌধুরী। আজ রাজ্যের ৪১ টি কেন্দ্রে তৃণমূল বিরোধিতা বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধিতার যে সুদ বিজেপি কার্যত বিনা পরিশ্রমে ঘরে তুলছে, একমাত্র বহরমপুর কেন্দ্রে তার সুফল পাবে কংগ্রেস। এর মধ্যে সিপিএমের, বিজেপির, উচ্চবিত্তের, উচ্চ-মধ্যবিত্তের কিংবা এক্কেবারে খেটে যাওয়া দরিদ্রতম মানুষের ভোটও ধরা আছে। শুধু সবার মধ্যে একটাই কমন মিনিমাম ফ্যাক্টর থাকতে হবে, তা হল, ‘বাকি সব পরে ভাবব, আগে মমতাকে হারাও, তৃণমূলকে শায়েস্তা করো’।
এই মমতা বিরোধিতাকে পুঁজি করেই নিজের কেন্দ্রে তৃণমূল বিরোধী সমস্ত ভোটকে এককাট্টা করতে নেমেছেন অধীর। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাঁর প্রিয় শহর বহরমপুর। শুধুমাত্র যে বিধানসভা কেন্দ্রেই গত লোকসভায় তার লিড ছিল ৯৮ হাজার ভোটের।
আর সঙ্গে আছে সিপিএম। যে অধীরকে টাইট দিতে এক সময় মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুর্শিদাবাদে বেছে বেছে এসপি পাঠাতেন, সেই অধীরই আজ মমতাকে টাইট দিতে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের প্রধান হাতিয়ার।

Comments are closed.