এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্বৈরাচারের নাম পুঁজিবাদ, বললেন অধ্যাপক আইজাজ আহমেদ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপোলিসে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর প্রেক্ষিতে দেশজুড়ে বিক্ষোভ চলছে। আমেরিকার গণ্ডি ছাড়িয়ে তা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে অন্যান্য দেশেও। যদিও মারণ ভাইরাসে মৃত্যু মিছিল এখনও অব্যাহত। এই সময় বিজয় প্রসাদকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ট্রাইকন্টিনেন্টাল: ইন্সস্টিটিউট ফর সোশ্যাল রিসার্চের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর তথা সমকালীন দুনিয়ার অন্যতম মার্ক্সবাদী বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক আইজাজ আহমেদ।
ইন্টারভিউতে মার্ক্সবাদী দার্শনিক আইজাজ আহমেদ জানিয়েছেন, কেন পুঁজিবাদী কাঠামো এই ধরনের বিক্ষোভ আন্দোলন সামলাতে ব্যর্থ হচ্ছে। কেনই বা পুঁজিবাদী সিস্টেমের শাস্তিমূলক ব্যবস্থাপনাকে এত অসহায় দেখাচ্ছে।

 

প্রশ্ন: জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর প্রায় গোটা বিশ্বেই আগুন জ্বলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে প্রতিবাদের শুরু, তা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বজুড়ে। নিজের চোখে যা দেখা যাচ্ছে মানুষ তাতে অধৈর্য হয়ে রাগ প্রকাশ করতে বাধ্য হচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু, তার প্রেক্ষাপট এবং সার্বিক অশান্তি মোকাবিলায় আমেরিকান সোসাইটিতে পুলিশের ভূমিকাকে কীভাবে দেখছেন?

আইজাজ আহমেদ: প্রাথমিকভাবে বলা যায়, পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ। আমেরিকান পুলিশ কিন্তু এমনিতেই সপ্তাহে গড়ে একজন করে কালো মানুষ হত্যা করে, নারী, পুরুষ নির্বিশেষে। অন্তত পরিসংখ্যান তাই বলে। এর আগে ফার্গুসনে বিরাট অভ্যুত্থান হয়। সেখান থেকেই ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার সংস্থার সূচনা। যা ফ্লয়েডের ঘটনার পর সম্পূর্ণতা পেয়েছে বলা যায়।
দ্বিতীয়ত, এগুলো আমেরিকায় চক্রাকারে ঘটে চলে। আমি যখন ওখানে থাকতাম, সেই সত্তরেও এই ধরনের ব্যাপার ঘটত… প্রবল পুলিশি অত্যাচার। কখনও কখনও তো অত্যাচারের ঘটনা ঘটত গোপনীয়তার চাদরে মুড়ে। প্রতিবাদে সেই সময়ও বিক্ষোভ আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে। এবং সেই প্রক্রিয়া এখনও চলছে।
তৃতীয়ত, আমার যেটা মনে হয়, এই হোয়াইট সুপ্রিমেসি। মনে হয় এটা কোনও একটা প্যাথোলজিক্যাল ব্যাপার, যে এত সংখ্যক মানুষ এই রোগে ভুগবেন। এই যেমন জো বিডেন সেদিন বলে দিলেন মাত্র ১৩ থেকে ১৫ শতাংশ আমেরিকান খারাপ মানুষ। এবার একে আপনি যে কোনওভাবেই সংজ্ঞায়িত করতে পারেন, কারণ তা দৃশ্যমান।
একইভাবে এই হোয়াইট সুপ্রিমেসির জাত্যাভিমানী সমাজের দ্বিতীয় ত্বক হয়ে ওঠার মত অবস্থা। পুলিশও ব্যতিক্রম নয়। পুলিশের মধ্যেও আছে হোয়াইট সুপ্রিমেসির প্রবল প্রভাব। ঘটনা হল তাঁদের হাতেই আবার বন্দুক, লাঠিসোটাও দেওয়া আছে।
এবং চূড়ান্ত কথা হিসেবে বলা যায়, জনসংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণ করার সময় পুলিশ, মানুষের মধ্যে একটা ছদ্ম নিরাপত্তা প্রদানের আস্তরণ তৈরি করে। যে ধারণা আমাদের বলে, ওঁরা যা খুশি করেও পার পেয়ে যেতে পারে এবং একই সঙ্গে সেই পুলিশ কর্মীরা নিজেরাও ভাবতে থাকেন, এটা বুঝি তাঁদের অধিকারের মধ্যেই পড়ে।
পৃথিবীর সর্বত্র, যেখানেই পুঁজিবাজের রাজত্ব, সেখানেই এই কায়দা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। আমেরিকার অবস্থা বিশেষভাবে বলার কারণ তাদের প্রেসিডেন্ট। যে মানুষটির এক এবং একমাত্র কাজ উসকানি দিয়ে যাওয়া, হিংসায় উসকানি। যিনি নাগরিক সমাজের প্রতিবাদ দমন করতে ওয়াশিংটনের রাস্তায় সেনা নামাতে পারেন। সাতের দশকে এর চেয়ে অনেক বড় মাপের আন্দোলন এবং বিক্ষোভ দেখেছে আমেরিকা, ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদে। কিন্তু সেই সময়ও এমনটা দেখিনি। বলা ভালো, এরকম হোয়াইট সুপ্রিমেসির প্রকাশ্য বিষোদগার দেখিনি। মাঝখান থেকে মানুষ সব কিছু দেখে এবং বুঝে মনমরা হয়ে পড়ছে। কারণ তারা বুঝতে পারছে, তাদের কথা বলার কিংবা প্রতিনিধিত্ব করার কেউ নেই।

 

প্রশ্ন: আপনি কি বলতে চাইছেন, পুলিশ এবং আধা সেনা কিংবা সেনার মধ্যে যে পার্থক্য ছিল, তা আজ আর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না? পুঁজিবাদী সমাজে পুলিশের ভূমিকা কী?

আইজাজ আহমেদ: একেবারেই তাই। বাকিদের বিশ্লেষণে পরে আসছি আগে আমেরিকার কথা বলি। একটা জিনিস খেয়াল করেছেন, আমেরিকানদের মধ্যে সব সময় একটা যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আছি মার্কা জাতীয়তাবাদী আবেগ কাজ করে? আপনার পুরুষত্বের সঙ্গে যেন সমার্থক হয়ে দাঁড়ায় যুদ্ধক্ষেত্রে বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে থাকা সৈন্যসামন্তরা। গোলমাল মেটাতে এক পক্ষ আরেক পক্ষের উপর গুলিভর্তি বন্দুক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। অর্থাৎ সমস্যা মেটাতে বন্দুকের ঢালাও ব্যবহার। এবার দেখুন বন্দুকের মালিক কারা। এখানেই আসছে গণতন্ত্রের প্রশ্ন। আপনারা ভারতের বাসিন্দা। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র। কিন্তু এই গণতন্ত্রেই তো শুনতে পাই লক্ষ লক্ষ শ্রমিক শ্রেণির মানুষ পায়ে হেঁটে হাজার কিলোমিটার চলে যাচ্ছেন, রেললাইনে তাঁদের উপর দিয়ে অবলীলায় ট্রেন চলে যাচ্ছে… গণতন্ত্র কিন্তু থেমে নেই, সে দিব্যি এগিয়ে চলেছে। এতগুলো লোকের সমস্যা কিংবা মৃত্যুর জন্য কারও শাস্তি হবে না, সরকারের কিংবা কোনও মন্ত্রী বা আমলার এজন্য কিছুই হবে না। ফলে আমি বুঝতে পারি না গণতান্ত্রিক দেশ বলতে ঠিক কী বোঝানো হয়।
এবার আসুন পুঁজিবাদের গোড়ার কথায়। লুইস আলথ্যুসর বলে গিয়েছিলেন, পুঁজিবাদী অর্থনীতির এক বছরের জন্যও পুনরুৎপাদন সম্ভব নয় যদি সে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কার্য কারণের উপর নির্ভরশীল হয়। এই ধরনের অর্থনৈতিক মডেল সফলভাবে চালাতে গেলে আপনার হাতে শক্তি প্রয়োগের কাঠামো মজুত রাখতেই হবে। শক্তি প্রয়োগের কাঠামোগুলোকে দৈনন্দিন জীবনে এনে ফেলাই আসল কাজ পুঁজির ধারকদের। আর তা করতে পারলেই আপনি যা যা করছেন, তার সবটাই রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠবে। আর মানুষ বশ্যতায় অভ্যস্ত হয়ে উঠবে।
যদিও প্রতিটি পুঁজিবাদী ব্যবস্থাতেই এই ভয় শাসক শ্রেণিকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তা হল, যে অংশ সম্পূর্ণ গতানুগতিকতার স্বার্থে তাদের সঙ্গে ছিল বলে মনে করা হয়েছিল, তাঁরা অর্থাৎ সেই চাপের মুখে মাথা নত করে রাখা শ্রেণির আচমকা অবাধ্য হয়ে ওঠার ভয়। এই অবাধ্যতার ভয় আটকাতেই ক্রমাগত পাল্টা ভয়, সন্ত্রাস আর শোষনের বাতাবরণ। পুলিশি জুলুম তার একটি অংশ মাত্র। তাই বলছি, এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্বৈরাচারের নাম পুঁজিবাদ।
আসলে যেটা বলতে চাইছি, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক পুনরুৎপাদন অসম্ভব যদি না ক্রমাগত হিংসার পরিস্থিতি বজায় থাকে। মানে, এই ব্যবস্থা চালাতে হিংসার ভূমিকা অবশ্যম্ভাবী। যা একটা সময় মানুষের কাছে স্বাভাবিক অবস্থার সমতুল হয়ে ওঠে। যখন দেশে বেকারত্বের হার বাড়তে শুরু করে, তা বিস্তার এবং তা ঠেকাতে দুই ক্ষেত্রেই প্রয়োজন হয় হিংসার। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত অবাধ্যতা মাথাচাড়া না দিচ্ছে, সবই শান্ত, স্বাভাবিক। ২০০৭-০৮ সালের অর্থনৈতিক দুরাবস্থার কথা মনে আছে তো? আমেরিকায় সেই সময় অন্তত ১০ মিলিয়ন মানুষ গৃহহারা হন। কিন্তু কোনও বড় বিক্ষোভ আন্দোলনের কথা মনে পড়ছে কি? হয়নি। কারণ পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতে ওই শ্রেণি অবাধ্যতার ভয় কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এটা আসলে সেই বশ্যতার অভ্যাসের ফল। এবার সেই হিসেবটা কিন্তু উল্টে গেছে। তাই খালি হাতে বিক্ষোভ দেখানো মানুষগুলোকে সামাল দিতে শেষ পর্যন্ত রণসাজে সজ্জিত সেনাবাহিনীর হুঙ্কার পর্যন্ত ছাড়তে হচ্ছে।

Comments are closed.