ক্রীড়া জগৎ তাঁকে চেনে ‘বাটারফ্লাই কুইন’ নামে। মাত্র ১৯ বছর বয়সে ইংলিশ চ্যানেল সাঁতরে পার হওয়ার সময় তাঁর সামনে দিয়ে ভেসে যাচ্ছিল একটা কচ্ছপ। প্রবল ঠান্ডায় তখন হাত পা যেন জমে যাচ্ছে। মনে হয়েছিল, কেউ যদি দশটা জ্বলন্ত উনুন পেটের কাছে রাখে তাহলে ভালো হয়। এক মুহূর্তের জন্য তাঁর মনে হয়েছিল, কচ্ছপটির পিঠে চেপে বাকিটা পার হয়ে যাবেন। ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করা প্রথম এশিয় মহিলা, আরতি সাহার ৮০ তম জন্মদিবস ২৪ সেপ্টেম্বর। বাঙালি কি মনে রেখেছে কিংবদন্তী সাঁতারু আরতি সাহাকে? মনে রেখেছে কিন্তু গুগল। দেশে প্রথম মহিলা ক্রীড়াবিদ হিসেবে পদ্মশ্রী পাওয়া আরতি সাহার ৮০ তম জন্মদিবসে তাঁকে ডুডলে শ্রদ্ধা জানাল গুগল।
তারিখটা ছিল ২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৯। ১৯ বছর বয়সে প্রথম এশিয় মহিলা হিসেবে সাঁতরে ইংলিশ চ্যানেল পার করেছিলেন উত্তর কলকাতার আরতি সাহা।
শৈশব ও সাঁতার
২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৪০ সাল। উত্তর কলকাতার সাহা বাড়িতে জন্ম আরতির। অল্প বয়সেই মাকে হারান। বাবা পাঁচুগোপাল সাহা চাকরি করতেন সেনাবাহিনীতে। সংসারে সময় দেওয়ার ফুরসত কোথায় তাঁর! ছোট্ট আরতি বেড়ে ওঠেন ঠাকুমার কাছে।
ভারতের অন্যতম সেরা সাঁতারু শচীন নাগের ছাত্রী আরতির সাঁতারে আগ্রহ জন্মায় কাকাকে দেখে। তখন মেরেকেটে বয়স চার বছর। সেই থেকেই কাকা বিশ্বনাথের সঙ্গে প্রতিদিন চাঁপাতলার ঘাটে স্নান করতে যেতেন আরতি। সেই শুরু হল ঢেউ কাটিয়ে জল পার করার অ্যাডভেঞ্চার। সাঁতারে মেয়ের অসীম উৎসাহের কথা জানতে পেরে বাবা তাঁকে হাটখোলা সুইমিং ক্লাবে ভর্তি করে দিলেন। তার এক বছর পরেই শৈলেন্দ্র মেমোরিয়াল সাঁতার প্রতিযোগিতায় ১১০ গজ ফ্রি-স্টাইলে প্রথম আরতি। স্বর্ণজয়ী সাঁতারু গুরু শচীন নাগের কোলে চড়ে পাঁচ বছর বয়সে পুরস্কার আনতে গিয়েছিল ছোট্ট মেয়েটি। সেখান থেকেই শুরু বাঙালি কন্যার সমুদ্র জয়ের প্রথম পদক্ষেপ।
১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫৬ সাল, ১০ বছর বহু সাঁতার প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেন আরতি। ইন্টারনেট বিহীন সে যুগে যদিও বিদেশে নাম ছড়িয়ে পড়তে বিশেষ অসুবিধে হয়নি। ১৯৫২ সাল। ফিনল্যান্ডের হেলসিঙ্কি সামার অলিম্পিকে সাঁতারু ডলি নাজিরের সঙ্গে আরতি ছিলেন ভারতের সর্বকনিষ্ঠ প্রতিনিধি! বয়স ছিল বারো।
অবশ্য ইংলিশ চ্যানেল পার করতে গিয়ে এলাম, দেখলাম আর জয় করলাম, এমনটা মোটেই হয়নি। চ্যাম্পিয়নকেও প্রথমবার ধাক্কা খেতে হয়। ইংলিশ চ্যানেল পার করতে গিয়ে প্রথমবার বিফল হন তিনি। কিন্তু ভেঙে পড়ার বান্দা নন আরতি সাহা।
বাঙালি কন্যার ইংলিশ চ্যানেল পার
২৭ অগস্ট, ১৯৫৯। শুরুতেই বিপত্তি! প্রায় চল্লিশ মিনিট দেরিতে ন্যাভিগেশন বোট এসেছিল। প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে ইংলিশ চ্যানেল পার করার উদ্দেশে আরতি ১৪ ঘণ্টা ১০ মিনিট সাঁতার কেটে ফেলেছেন তখন। গন্তব্যে পৌঁছতে বাকি আর মাত্র ৩ মাইল। কিন্তু হল না। বোটম্যান ঘুরপথে নিয়ে যাওয়ায় স্রোতের বিপরীতে পড়ে যান আরতি। তাঁর পাশে তখন সাঁতার কাটছেন ১৯৪৮ সালের লন্ডন অলিম্পিকের সোনাজয়ী সাঁতারু গ্রেটা অ্যান্ডারসন। এদিকে প্রবল সমুদ্রস্রোত ঠেলে আর এগোতে পারছেন না দেখে বোটম্যান আরতিকে ছুঁয়ে দেন। নিয়ম অনুয়াযী সাঁতারুকে কেউ স্পর্শ করলে তিনি সেই প্রতিযোগিতা থেকে বাতিল হয়ে যান। অতএব প্রথমবারে ইংলিশ চ্যানেল অসমাপ্ত রেখেই উঠে আসতে হয়েছিল আরতিকে।
রেকর্ডের হাতছানিতে এত কাছে গিয়েও তাকে না ছুঁয়ে ফিরে আসা, মনখারাপ হবে বৈকি। তবে ভেঙে পড়েননি আরতি। গুরু শচীন নাগের তত্বাবধানে ফের শুরু কঠোর অনুশীলন। সে বছরেই এশিয়ার প্রথম মহিলা সাঁতারু হিসেবে ইংলিশ চ্যানেল পার করে রেকর্ড গড়লেন আরতি সাহা। ১৯৫৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সাঁতরে ইংলিশ চ্যানেল পারা করতে আরতি সাহার সময় লেগেছিল ১৬ ঘণ্টা ২০ মিনিট। ফ্রান্সের কেপ গ্রিস নে থেকে ইংল্যান্ডের স্যান্ডগেট। ভোর ৫ টা ৫৫ মিনিটে জলে নেমে ৪২ মাইল পথ অতিক্রম করতে হয়েছিল তাঁকে। চ্যানেলের একটি বন্দর ফকস্টোন থেকে ৫ মাইল দূরে স্যান্ডগেটে বোট থেমে গেলেও নিয়ম অনুযায়ী ১০ গজ মতো পথ হেঁটে যেতে হয় প্রতিযোগীদের। সেটা পার করে অবশেষে সাফল্য পান আরতি সাহা।
যদিও অভিযান নিয়ে চিন্তায় ছিলেন আরতি সাহা। তাঁকে আর্থিক সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়, প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, প্রফুল্লচন্দ্র সেন সহ অনেকেই। ১৯৬০ সালে প্রথম মহিলা ক্রীড়াবিদ হিসেবে পদ্মশ্রী সম্মানেও ভূষিত হন তিনি।
গুগল ডুডলে সেই দুঃসাহসিক অভিযাত্রীর ৮০ তম জন্মদিনকে স্মরণ করে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে বৃহস্পতিবার। ১৯৯৪ সালে মাত্র ৫৪ বছর বয়সে মৃত্যু হয় কিংবদন্তী সাঁতারু আরতি সাহার।
Comments are closed.