প্রয়াত অটল বিহারী বাজপেয়ী ছিলেন এক বিরাট মাপের রাজনীতিবিদ, দক্ষ সাংসদ, সুবক্তা, সাহিত্য রসিক, ভদ্রলোক এবং উগ্র এক সংগঠনের নরম সদস্য।
বাজপেয়ীকে তাই বলে উদার ভাবার কোনও কারণ নেই। একদা আর এক প্রধানমন্ত্রী ভিপি সিংহ বলেছিলেন, ৯০-এর দশকে বাজপেয়ী ও যশোবন্ত সিংহ তাঁর কাছে এসেছিলেন নতুন এক রাজনৈতিক দল গঠন করার প্রস্তাব নিয়ে। বাজপেয়ীর মনোভাব নিয়ে সন্দিহান ভিপি সেই প্রস্তাব পত্রপাঠ খারিজ করে দেন। বিশ বছর বয়সে বাজপেয়ী আরএসএসে যোগ দিয়েছিলেন, এবং তার সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ভাল তালিবান বা মন্দ তালিবান বলে যেমন কিছু হয় না, তেমনই আরএসএসের সদস্যদের মানসিকতা যে একই রকম, তা বুঝে ওঠার জন্য ভীষণ মেধা ও যুক্তিবোধের দরকার পড়ে না। কিন্তু বাজপেয়ী সংঘের অন্য সদস্যদের থেকে নিশ্চয় স্বতন্ত্র ছিলেন—কারণ তিনি মুরগির মাংস খেতে পছন্দ করতেন, খেতেন কাবাব, স্কচ হুইস্কিরও ভক্ত ছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী। এই খানেই মোদীর সঙ্গে তাঁর তফাত—অন্য আর কোনও তফাৎ আছে বলে মনে হয় না। নীতির প্রশ্নে দুজনেই আদর্শ আরএসএস—দুজনের সংঘ নৈতিকতায় কোনও ভেজাল নেই।
যেমন মোদীর সঙ্গে আদিত্যনাথ যোগীর পার্থক্য, ঠিক তেমনি বাজপেয়ীর সঙ্গে মোদীর। মোদীর প্রাইভেট আর্মি নেই কিন্তু যোগীজির আছে। বাজপেয়ী কবিতা লেখেন, মোদী বা যোগী লেখেন না। এ সব আপাত পার্থক্য। আসলে এই সব তুচ্ছ পার্থক্য মায়া। লক্ষণা করে বুঝতে হয়, ওই সব স্বল্প বিশেষণের চেয়ে বেশি দামী তাঁদের অনুগতএক নীতি। এক ব্রহ্ম (পড়ুন, সংঘনীতি) সত্য—বাকি সব মিথ্যা ও অনির্বচনীয়। মোদী যদি ব্যবহারিক সৎ হন তবে যোগী প্রাতিভাসিক। আর বাজপেয়ীজি তো কদিন আগে পারমার্থিক সত্তায় বা পরমাণু ব্যোমে বিলীন হয়ে গেছেন। ব্যোমের বা ইথারের গুণ শব্দ—আর কে না জানে, শব্দই ব্রহ্ম। মাননীয় মৃত প্রধানমন্ত্রীর দু চারটে লোভনীয় শব্দ শুনে নেওয়া যাক।
লোভ সাময়িক সংবরণ করে বাজপেয়ীর কয়েকটি সদ্গুণ জেনে নেওয়া আবশ্যক। তার পর তাঁর বাণীতে প্রবেশ করা যাবে। ভারতরত্ন বাজপেয়ী নাকি প্রথম জীবনে কমিউনিস্ট ছিলেন। কী আশ্চর্য? যক্ষ থাকলে বেশ অবাক হয়ে যেতেন। বকরূপী যক্ষ অবশ্য কমিউনিস্ট বাজপেয়ীর সংঘে যোগ দেওয়াকে ধার্মিক বলে বার্তা দিতে পারেন। আরও বার্তা হল, ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিলেও অটলজি আরএসএসের সদস্যপদ বহাল রাখেন। বিজেপির অগ্রজ বিজেএস বা ভারতীয় জন সংঘের প্রাণপুরুষ শ্যামাপ্রসাদের ঘোর ভক্ত হয়ে ওঠেন অটল। এই সেই শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি, যিনি মুসলিম লিগের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে ক্ষমতার লোভ ত্যাগ করতে পারেননি, যাঁকে আমরা দেশভাগের (বাংলাভাগের) খলনায়ক বলে চিনি, যাঁর লোকদের প্রকাশ্যেই ঠেঙাত নেতাজি সুভাষের অনুগত বাহিনী। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আরএসএসের গোলওয়ালকর, সাভারকর, শ্যামাপ্রসাদ শুধু ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতাই করেননি, আন্দোলন দমন করতে ব্রিটিশ সরকারকে সাহায্যও করেছিলেন। এই আন্দোলনে মাননীয় অটল বিহারী ও তাঁর দাদা প্রেম বিহারী ব্রিটিশ পুলিশকে সাহায্য করে কাকুয়া ওরফে লীলাধর নামে এক স্বাধীনতা সংগ্রামীর হাল হকিকত জানিয়ে দেন। পুলিশ সেই বিপ্লবীকে গ্রেপ্তার করতে সমর্থ হয়। এমন একজন মহান দেশপ্রেমিক নেতা যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী হলেন, তখন রাষ্ট্রের কোন কোন মঙ্গল তিনি সাধন করবেন, সে সব নিয়ে কোনও দ্বিমত পোষণ করার অবকাশ নেই। উদারীকরণ-বিলগ্নীকরণের যে জাঁতাকল বাজপেয়ী স্থাপন করে গিয়েছেন, সেই জাঁতায় পিষ্ট গোটা ভারতবর্ষ। মোদী-যোগীরা তাতে পিষছেন ভারতের সাধারণ মানুষকে, আর আটা খাচ্ছেন শিল্পপতিরা।
একটু আগে বলছিলাম, শব্দ হল ব্যোম পরমাণুর গুণ, আবার শব্দই ব্রহ্ম। পারমার্থিক সত্তায় লীন হয়ে যাওয়া বাজপেয়ীজি ১৯৯২ সালের ৫ ডিসেম্বর ঠিক কী বলেছিলেন উত্তর প্রদেশের রাজধানী লখনউর আমিনাবাদে? ইউটিউব সার্চ করলেই সেই বাণী পাওয়া যায়। তিনি বলেছিলেন, (বাবরি মসজিদ) গুঁড়িয়ে না দিলে মন্দির হবে কী প্রকারে? ঠিক তার পর দিন উন্মত্ত করসেবকরা লখনউর অদূরে অযোধ্যায় গুঁড়িয়ে দিল ঐতিহাসিক এক মসজিদ, যার নাম বাবরি মসজিদ। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা লুন্ঠিত হল শাসক দলের হাতে। ১৯৯২ সালে বিজেপির একটি রাজনৈতিক সমাবেশের উদ্যোক্তারা, ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অনুযায়ী মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় একটি রাজনৈতিক সমাবেশ শুরু করে। সেখানে লোকসংখ্যা ছিল ১৫০,০০০। এত জনের সম্মিলিত হুঙ্কারে সমাবেশ দাঙ্গার রূপ নেয় এবং বাবরি মসজিদকে পরিকল্পনামাফিক সম্পূর্ণরূপে ভূমিসাৎ করা হয়। তার পরের ঘটনা সকলের জানা। ওই এক মাসে ভারতের প্রধান শহরগুলোতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়, যা মুম্বই ও দিল্লি শহরে ২০০০ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়।
শেষ হয়নি সেই দাঙ্গা। এই দাঙ্গা না হলে বিজেপি কোনও দিন ক্ষমতায় আসতে পারত না। আডবাণীকে একা কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে লাভ নেই। মোদী ছিলেন তাঁর অভিভাবক। সেদিনের কট্টর আডবাণী মোদী রাজত্বের নরম মুখ হয়ে গেলেন। বিজেপি ও সংঘ পরিবারের এক এক কৌশল। এবং তারা জানে যে, এই সন্ত্রাস ও দাঙ্গার রাজনীতি ছাড়া ক্ষমতায় থাকা সম্ভব নয়। তার পর এল ২০০২-এর সেই ভয়াবহ দাঙ্গা, যার নায়ক নরেন্দ্র দামোদর মোদী। আর বাজপেয়ী?
মুসলমানদের অর্থনৈতিকভাবে শেষ করে দিতে এবং মেরুকরণের তীব্র বিভাজনে ভোটে ফায়দা তুলতে শুরু হয় গুজরাত দাঙ্গা। নরম বাজপেয়ীজির গোয়া ভাষণ, ২০০২ শোনা যাক। শুরু করলেন, কাম্বোডিয়া ছিল হিন্দু রাষ্ট্র। তার পর এল হিন্দুদের উদারতার বাণী। মুসলমানরা কত খারাপ ইত্যাদি। “মুসলমানরা যেখানে বাস করে সেখানেই গোলমাল পাকায়। কোথাও তারা শান্তিতে বাস করতে পারে না।” দেশে বিদেশে এই ভয়াবহ দাঙ্গা নিয়ে যখন ভারতের মুখ কালিমালিপ্ত, তখন কে চেনে মোদীকে! বিদেশে বাজপেয়ীর নামে ধিক্কার উঠল চরমে। পাশে শিষ্য মোদীকে বসিয়ে অভিভাবক বাজপেয়ী রাজধর্ম পালনের আদেশ দিলেন। শিষ্য বললেন, তিনি তো রাজধর্মই পালন করছেন। অভিভাবক উত্তর দিলেন, হ্যাঁ। নরেন্দ্র যথার্থ রাজধর্ম পালন করছেন। নিশ্চয় এক মহান নেতা ছিলেন অটল বিহারী। জুরুর বেশক! ইউটিউবে পাওয়া যাবে সেই যুগলবন্দী। শোনা যায়, ২০০২ সালে গোয়ায় বিজেপি কার্যসমিতির বৈঠকে মোদী রীতিমতো ‘ব্ল্যাকমেল’ করেন বাজপেয়ীকে। কর্মসমিতি থেকে ইস্তফা দেওয়ার হুমকি দেন। আডবাণী পাশে দাঁড়ান মোদীর। পিছু হঠেন বাজপেয়ী। আসলে সব এক—ভুল করে আমরা ভিন্ন ভাবি, বিবেকজ্ঞান হলে জানা যায়, বাজপেয়ী-আডবাণী-মোদী-যোগী সবাই এক ও অভিন্ন।
বেচারা বলরাজ মোদকের কথা আর নাই বা তোলা হল। নাই বা উঠল বাজপেয়ীর বিরুদ্ধে গদ্দার-অভিধায় ভূষিত হওয়ার নানা অভিযোগ। মৃতকে অসম্মান করা অসভ্যতা। তাঁদের সম্মান জানানো এই দেশের তমদ্দুন বা সংস্কৃতি। সব ভুলে মাফ করে দিতে হয়। কিন্তু জ্যান্ত মানুষের ক্ষেত্রে এই নিয়ম খাটে না। শুধু মৃত জনদের এই পরিষেবা দিন। তাই অটলজীর আত্মার চিরশান্তি কামনা করাই মঙ্গল। বাকিদেরও যেন সেই সম্মান জানানো হয়, দেশবাসীর কাছে এই অনুরোধ—পরমে পরম জানিয়া।
এসেছি হেথায় তোমার আজ্ঞায়
আদেশ করিবা মাত্র যাব চলিয়া
পরমে পরম জানিয়া।
জয় হিন্দ! বন্দে মাতরম!
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Comments are closed.