বই আঁকড়ে বাঁচতে চান, আংশিক লকডাউনে কর্মহীন ট্রেনে বইওয়ালা দীপঙ্কর
প্রথাগত পড়াশোনা নেই, তবে ছোটো থেকেই বই পাগল দীপঙ্কর বাবু
বই ভালোবাসেন, সেই সঙ্গে তাঁর ইচ্ছে শত ব্যস্ততার মধ্যেও দিনের শেষে মানুষ যেন অন্তত ১৫ মিনিটের জন্য বই পড়েন। স্রেফ ভালোবাসা থেকেই ৩০ বছর ধরে বই বিক্রি করে চলেছেন। না কোনও স্থায়ী দোকান নেই তাঁর। বিগত ৩০ বছর ধরে ট্রেনেই বই বিক্রি করছেন। শিয়ালদহ মেন লাইনে বইপ্রেমী যাত্রীদের অনেকের কাছেই পরিচিত নাম বই বিক্রেতা দীপঙ্কর কুণ্ডু।
রাজ্যে ফের আংশিক লকডাউনে ট্রেন বন্ধ হওয়ায় আপাতত কর্মহীন। জানালেন, এক জায়গায় রং মিস্ত্রির কাজের কথা হচ্ছে। লকডাউন পরিস্থিতি বেশিদিন চললে হয়ত বই বিক্রি ছেড়ে রং মিস্ত্রির কাজ করতে যাবেন।
প্রথাগত পড়াশোনা নেই, তবে ছোটো থেকেই বই পাগল দীপঙ্কর বাবু। সেই ভালোবাসা থেকেই বই বিক্রির পেশায় আসা। অত্যন্ত হতাশার সঙ্গে জানালেন, আগে ভাবতাম বই আঁকড়ে বাঁচা যায়, কিন্তু বাস্তবে শুধু বইয়ের উপর নির্ভর করে দিন গুজরান হয় না।
অতীত থেকে সাম্প্রতিক, সাহিত্যের সেরা কাজগুলিই পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেন। বর্তমানে কোন লেখক ভালো লিখছেন, সাহিত্যে কোন কাজটা ভালো হচ্ছে সব শ্যামনগরের দীপঙ্করের নখদর্পনে। বিক্রির সঙ্গে বই পড়েনও নিয়মিত।
বইয়ের সূত্রেই আলাপ একাধিক বিশিষ্ট মানুষের সঙ্গে। নিজের কথা বলতে গিয়ে তাঁর অনুরোধ, পারলে কয়েকজনের নাম লিখবেন, এঁদের অবদান আমার জীবনে অনস্বীকার্য। যাদবপুরের ইতিহাসের অধ্যাপিকা অনুরাধা রায়, অমর মিত্র, শঙ্খদ্বীপ ভট্টাচার্য সকলেই তাঁর ক্রেতা, অসময়ে পাশে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দীপঙ্কর সাহায্য নিতে চাননি। বললেন, জানেন আগের লকডাউনে ট্রেন বন্ধ থাকায় আমি জুটমিলে কয়েকদিন কাজ করেছিলাম। তখন অনিতা অগ্নিহোত্রী আমায় বলেছিলেন, দীপঙ্কর তুমি জুট মিলে কাজ করবে না। কোনরকম অসুবিধা থাকলে আমায় বলো! এক চিলতে হাসি এনে বললেন, এত বড় পাওনা তো বইকে ভালোবাসার জন্যই বলুন।
বইয়ের হকারি করে তেমন রোজগার হয় না। প্রথম প্রথম বাড়ির লোকেও আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু তাঁর জেদের কাছে হার মেনেছেন পরিবারের লোকজন। বললেন, আস্তে আস্তে বই ভালোবাসতে শুরু করেছে। বাড়িতে রয়েছে ছেলে, মেয়ে এবং স্ত্রী।
নিজের কথা বলতে গিয়ে তাঁর সঙ্গেই হকারি করেন এমন কয়েকজনের কথাও বললেন। দীপঙ্করের আর্জি, আমি তো তাও ভালো আছি। আমার সঙ্গেই দু’জন হকারি করেন। একজনের একটি হাতের কব্জি নেই, তাঁর স্ত্রী অন্ধ। ট্রেনে খাজা বিক্রি করেন। আরেক জনের দুটো হাত নেই, ট্রেনে লজেন্স ফেরি করেন। ট্রেন বন্ধ হওয়ায় এঁদের দুর্দশার কথাও সবার জানা দরকার। ওঁরাও তো আমাদের সহ নাগরিক, মন্তব্য বই বিক্রেতা দীপঙ্করের।
নিজে এত বই পড়েন কখনও লিখতে ইচ্ছে হয়নি? ইচ্ছে তো করে, কিন্তু লেখার জন্য যে অবকাশ দরকার সেটা কোথায়? দৌড়তে দৌড়তে কখন যে সময় বেরিয়ে গেল, বুঝতেই পারিনি। দীপঙ্কর মনে করেন, বই বিক্রি আসলে অন্ধকে চশমা বিক্রির মত, এই নিয়েই বেশ আছি।
তাঁর আবেদন, সরকার যদি একটা দোকান করতে সাহায্য করত, তাহলে কিছুটা সুবিধা হত। আসলে ট্রেনে ঠিকঠাক বই বিক্রি করা যায় না। কাউকে হাতে কোনও বই দিলে সেটা একটু নেড়েচেড়ে দেখারও তো সময় দিতে হবে, নাকি? একটা বই ঠিক করে নেড়েচেড়ে দেখতে না দেখতেই পরের স্টেশন চলে আসে।
Comments are closed.