লাদাখ সীমান্তে ফের চিনের রণ হুঙ্কার। যুদ্ধসাজে ভারতীয় সেনাও। বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ক’দিন আগেই বলেছিলেন ৬২ এর যুদ্ধের পর সীমান্ত উত্তেজনা আর এই পর্যায়ে পৌঁছয়নি। বিগত কয়েক মাস ধরে চলা সীমান্ত সমস্যা ক্রমেই কি আরও জটিল আকার নিচ্ছে? এই প্রশ্নেই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের কূটনীতি। কিন্তু চিনের এমন আগ্রাসনের কারণ কী?
চিনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল মানুষেরা এই প্রেক্ষিতে তুলে আনছেন শি জিনপিংয়ের ‘ক্লিন প্লেট ড্রাইভ’ তত্ত্ব। তাঁরা বলছেন, রাতারাতি এমন আগ্রাসনের কারণ লুকিয়ে জিনপিং ঘোষিত এই কর্মসূচির আড়ালে।
কী এই ‘ক্লিন প্লেট ড্রাইভ’?
মাত্র কয়েক মাস আগে চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং একটি সরকারি কর্মসূচির সূচনা করেন। মার্কিন মিডিয়ার কাছে যার পোশাকি নাম ‘ক্লিন প্লেট ড্রাইভ’। এই কর্মসূচিতে শি দেশবাসীর কাছে খাবার থালা সাফ করার আহ্বান জানিয়েছেন। অর্থাৎ খাবার নষ্ট না করার আবেদন। কেন শি জিনপিং এমন আবেদন নিয়ে দেশজুড়ে কর্মসূচি শুরু করলেন? চিন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর নেপথ্যে রয়েছে খাঁটি অর্থনীতি। চিন বর্তমানে খাদ্য সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতি এমন যে সরকারি দফতর বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানিয়েছে, বাইরে থেকে খাদ্য সামগ্রী আমদানি করার বিষয়ে কোনও সরকারি বিধিনিষেধ রাখা হচ্ছে না।
এবার প্রশ্ন হল, চিনে খাদ্য সঙ্কটের কারণ কী? সম্প্রতি প্রথম ত্রৈমাসিকের হিসেবে বিশ্বে একমাত্র বৃদ্ধি পেয়েছে চিনের অর্থনীতি। কিন্তু অর্থনীতিবিদদের একাংশ বলছেন, চিনের অর্থনীতি আগাগোড়া ম্যানুফ্যাকচারিং নির্ভর। অর্থাৎ কোম্পানিতে মাল তৈরি হবে, সেই মাল রফতানি হবে দেশে-বিদেশে। কিন্তু সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মাসুল যুদ্ধ এবং করোনাভাইরাস সেই প্রক্রিয়াকে ভেস্তে দিয়েছে।
আবার কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক আধুনিকীকরণের জেরে চিনে চাষবাস আর শ্রম নিবীড় নয়। শি জিনপিংয়ের ক্ষমতায় বসার পরপরই শহরে চলো কর্মসূচি গতি পায়। অর্থাৎ চাষবাসের আশায় গ্রামে না পড়ে থেকে শহর বা শিল্পাঞ্চলে গমন। কাতারে কাতারে মানুষ শহর বা শিল্পাঞ্চলে গিয়ে লাখো সংস্থায় কাজও পেয়েছেন। আবার প্রযুক্তি নির্ভর কৃষিতে ক্রমেই শ্রমদানকারীদের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। যতক্ষণ চিনের ম্যানুফ্যাকচারিং ইকোনমি ঠিকঠাক চলছিল অর্থাৎ উৎপাদন ও রফতানির হার সমান ছিল, সমস্যা হয়নি। কিন্তু করোনার জেরে রফতানি ধাক্কা খেতেই কমে গিয়েছে উৎপাদন। ক্রমশ বন্ধ হয়েছে বহু কারখানা। স্বভাবতই কাজ হারিয়েছেন বহু। ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও কমেছে।
এই পরিস্থিতিতে গোটা চাপ এসে পড়েছে কৃষির উপর। কিন্তু সেখানেও বিধি বাম। এই যুগপত সমস্যায় এখন ক্ষোভে ফুঁটছে চিন। যতটা সম্ভব ঢাকাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেও মাঝেমাঝেই তা বেরিয়ে পড়ছে। অস্বস্তি বাড়ছে জিনপিংয়ের। আর এই অস্বস্তির দিক থেকে দেশবাসীর নজর ঘোরানোর অব্যর্থ পথ জাতীয়তাবাদের ঢেউ। স্বভাবতই পথ বেছে নিতে ভুল করেননি মাও জে দংয়ের উত্তরসূরী। তারই ফলশ্রুতি লাদাখ সীমান্তে চৈনিক আগ্রাসন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ঠিক একই রকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল ১৯৬২ সালেও। তখন দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সরকার বিরোধী ক্ষোভ মাথাচাড়া দেওয়ার পরিস্থিতি হয়েছিল। সেখানে জাতীয়তাবাদের ধুয়ো তুলে ভারত আক্রমণ করে দেশবাসীর নজর ঘোরাতে পেরেছিলেন মাও, বলে দাবি কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের। তাঁরা বলছেন, শি জিনপিংয়ের সামনেও এখন সেই একই চ্যালেঞ্জ। মাওয়ের শিষ্য গুরুর পথই ধরেছেন।
Comments are closed.