CAA-NRC: নাগরিকের কাছে নাগরিকত্বের প্রমাণ চাওয়া মাসির গোঁফ গজানোর মতোই

নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে সারা দেশ জুড়ে যে জনজাগরণ হয়েছে তা বিস্ময়কর, কারণ স্বাধীনতার পরে বিশেষ প্রত্যক্ষ কোনও রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব ছাড়াই শুধুমাত্র সাধারণ মানুষের উদ্যোগে এই আন্দোলন অভূতপূর্ব । জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে জয়প্রকাশ নারায়ণের আন্দোলন ছিল মূলত রাজনৈতিক। ইন্দিরা জমানার অবসান ঘটিয়ে পুরোনো কংগ্রেসীদের ক্ষমতা দখলের একটি পর্ব ছিল সেই আন্দোলন । যদিও সেই আন্দোলনে মিশে গিয়েছিল নানান ধারার গণতান্ত্রিক সত্তা। ইন্দিরা গান্ধী যেভাবে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির কণ্ঠরোধ, নাগরিক অধিকারের প্রায় অবসান চেয়েছিলেন, জরুরি অবস্থার দিনগুলিতে তার একটি যথার্থ বিরোধিতার প্রয়োজন ছিল রাজনৈতিক স্তরে। জয়প্রকাশ নারায়ণ সেই সামগ্রিক গণতান্ত্রিক চাহিদাকে একটি রাজনৈতিক অভিমুখ দিয়েছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীকে পরাজিত করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন পুরোনো কংগ্রেসীরা কিন্তু তাঁদের সাথে একদিকে যেমন ছিলেন অতি দক্ষিণ পন্থী সঙ্ঘ পরিবারের সদস্যরা, আবার এসেছিলেন একঝাঁক নতুন যুব নেতা। সঙ্ঘ পরিবার এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে যেমন নিজেদের সংগঠনের পরিধি বিস্তৃত করে, তেমনই যুব নেতারা পরবর্তীতে ভারতীয় রাজনীতির উজ্জ্বল তারকা হয়ে ওঠেন।

অপর দিকে কংগ্রেস নেতৃত্ব কিন্তু একটি রাজনৈতিক রেটোরিকেই আটকে গেলো। তাঁরা সেই ইন্দিরা গান্ধীর উপরেই নির্ভরশীল রইলেন এবং একই পারিবারিক লিগ্যাসিকে বহন করতে থাকলেন। জনতা সরকার টিকলো না। ইন্দিরাও নিজের অবস্থান সংশোধন করে ফিরে এলেন ক্ষমতায়, কিন্তু যে গণ আন্দোলনের ঢেউ একবার উঠেছিল তা ডান, বাম ঘোরাঘুরি করতে লাগলো। দেশজুড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিও মাথাচাড়া দিল। ইন্দিরা এক প্রবল রাষ্ট্রীয় শক্তির দ্বারা তা দমন করতে গেলেন, কিন্তু সাফল্য এলো আংশিক। নিজের প্রাণ দিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আপন রাজনৈতিক অবস্থানকে স্বীকৃতি দিলেন। এরপরও কংগ্রেস সেই পরিবারের বাইরে বেরোতে পারলো না। তার ফলে অকংগ্রেসী দলগুলি ক্রমশই শক্তি সঞ্চয় করে ভারতীয় রাজনীতিতে প্রবল প্রতাপশালী হয়ে উঠল। নরসিংহ রাওয়ের সংখ্যালঘু সরকার সেই প্রবাহকে প্রতিহত করতে পারেনি । শুধু বাবরি ধ্বংসই নয়, সামাজিক স্তরেও অতি দক্ষিণ পন্থী শক্তির একটি গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি হতে থাকে। ইউপিএ জমানার নানান আর্থ-সামাজিক সংস্কারের ফলে এই প্রবাহ কিছুটা বাধাপ্রাপ্ত হলেও, যে মুহূর্ত থেকে ক্রমাগতভাবে সেই পারিবারিক নেতৃত্বের ছায়া দীর্ঘতর হয়ে উঠল দেশের মানুষ নরেন্দ্র মোদীকে পরিত্রাতা ভেবে বসলেন।

 

আরও জানতে ক্লিক করুন, নাগরিকত্ব প্রমাণে লাগবে ধর্মীয় পরিচয়ের উল্লেখ

মোদী প্রথম ইনিংস খুব খারাপ খেলেন নি। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে নন স্ট্রাইকার’স এন্ডে যাঁকে দাঁড় করিয়েছেন, তিনি একাই সরকারকে বিচ্যুত করার জন্য যথেষ্ট । জনসভার বক্তৃতা আর সংসদীয় বিতর্কের মধ্যে যে তফাৎ আছে সেটা বিরোধীরা খেয়াল না রাখলেও, সরকারকে রাখতেই হয়। নয়তো সরকারের অভিমুখ নষ্ট হয়। অ্যাজেন্ডা যাই হোক, সংবিধান মেনে সরকার চালানোর কৌশল সবাই রপ্ত করতে পারেন না। প্রথম ইনিংসে বিমুদ্রাকরণ একটি ভুল পদক্ষেপ । কিন্তু অর্থনৈতিক পদক্ষেপ। দ্বিতীয় ইনিংসে আমরা অবাক হয়ে দেখি, যে রামমন্দির নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট একটি রায় দিল আর বিজয় গৌরবে সেইদিন সন্ধ্যায় আচমকা প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে দিলেন? এরকমটা আগে কখনও হয়েছে?

সিএএ, এনআরসি নিয়ে তো কত রকমের কথাই না বলছেন! আশ্চর্য লাগে কীভাবে কেন্দ্রীয় সরকার ভোটার তালিকাকে গুরুত্ব দেন না? ভুয়ো ভোটার থাকতেই পারে। কিন্তু সেটা চিহ্নিত করার জন্য সবাইকে ধরে টানাটানি করার কী দরকার? সবাইকে ডিটেনশন ক্যাম্পে ঢুকিয়ে বা দেশটাকেই ডিটেনশন ক্যাম্প হিসেবে ঘোষণা করে দিয়ে তারপর একে একে ছাড় দিলেই হতো। পাগলামো করতে হলে ভালোভাবে করা ভালো। সেয়ানা ভাবটি পরিত্যাগ করা উচিত ।

আরও জানতে ক্লিক করুন, এনপিআরে জানাতে হবে আপনার মাতৃভাষা

বিজেপির বন্ধুরা বুদ্ধি দিচ্ছেন যে, পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তুদের নিয়ে একটা আবেগ তৈরি করা যায় এই আইনের দ্বারা। ভালো। চেষ্টা করে দেখতে পারেন। পূর্ব বঙ্গ থেকে আসা, কিন্তু এখন যথেষ্ট ধনী ব্যক্তিদের কথা বাদ দিচ্ছি। প্রকৃত উদ্বাস্তু কলোনির মানুষের কাছে গিয়ে দেখুন, কী হয়! আমি প্রায় একটা গোটা জীবন কলকাতার অন্যতম বৃহৎ উদ্বাস্তু কলোনির মাঝে বসবাস করে কাটিয়ে দিলাম। উদ্বাস্তু আবেগ কী বস্তু তা আমি সম্যকভাবে জানি। একবার এখানে এসে বলে দেখুন যে আপনাদের একটা ফর্মে সই করতে হবে, ব্যস তাহলেই নাগরিক হয়ে যাবেন! যেমনটা পশ্চিমবঙ্গের বড়, মেজো, সেজো বিজেপি নেতারা বলে চলেছেন। শুধু একটি বার এসে বলুন। তারপর দেখুন কী উত্তর পান। স্বাধীনতার পর ওপার বাংলা থেকে সর্বস্ব ত্যাগ করে যাঁরা এপারে চলে এসেছিলেন, তারপর বহু কষ্ট করে ধীরে ধীরে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন, পরের প্রজন্মের জন্য কিছু রেখে যেতে চেষ্টা করেছেন, এতদিন ভোট দিয়ে সরকার গড়েছেন, তাঁরা আবার নতুন করে নাগরিক হবেন? আশ্চর্যজনক হলেও, বিজেপির ভোট কিন্তু বেড়েছে কলকাতার সেইসব জায়গায় যেখানে ঘটিদের সংখ্যা বেশি। যেমন, ভবানীপুর। এই ঘটিরা কোনওদিনই কোন ধর্মীয় কারণে নির্যাতনের শিকার হননি। কোথাও থেকে পালিয়েও আসেননি।

৫ বছরের কম বয়সী ৩৮% শিশুরই নেই বার্থ সার্টিফিকেট! কীভাবে পাবে তারা নাগরিকত্ব? আরও জানতে ক্লিক করুন

সামগ্রিকভাবে লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিজেপির যে ভোট বৃদ্ধি হয়েছে, তা হল বিরোধী ভোটের একত্রীকরণ। বাম ভোট এবং গোষ্ঠী দ্বন্দ্বপ্রসূত তৃণমূলের কিছু ভোটের ভাঙন বিজেপির দিকে গেছে। সেই অবস্থার সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়েছে এটা বলা যাবে না। কিন্তু নাগরিক আন্দোলনের যে অভিমুখ, সাধারণ মানুষের যা মতামত তাকে শিরোধার্য করেই তো রাজনৈতিক দলগুলিকে এগোতে হবে। নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও তা অপরিহার্য। সেই হিসেবে বাম-কংগ্রেস জোটের আর হারানোর কিছু নেই। এখন সময় এসেছে নিজেদের শক্তিকে সংহত করে ধীরে ধীরে সমর্থন পূর্বাবস্থায় নিয়ে যাওয়া। তা অসম্ভব নয়। সঠিক রাজনৈতিক পথে চললে তৃণমূলের একমাত্র বিকল্প হিসেবে বাম কংগ্রেস জোটই যে নির্ভরযোগ্য এটা সাধারণের বোধগম্য হতে হবে। একগুচ্ছ দিল্লির নেতা আর অসাংবিধানিক এবং দুর্বোধ্য রাজনৈতিক কথাবার্তা বলা দলটি সমর্থন হারাতে বাধ্য। মাসির গোঁফ গজানোর মতো নাগরিকের নাগরিকত্বের দাবি করা নেতারা স্বখাত সলিলেই না ডুবে যান! মাসির গোঁফ গজালে তিনি কি মেসো হয়ে যান?

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Comments are closed.