বিশ্বের বৃহত্তম লকডাউনে দারিদ্র্যের অন্ধকারে ১ কোটি ২০ লক্ষ ভারতীয়, গত মাসে কাজ হারিয়েছেন ১২ কোটিরও বেশি মানুষ, বলছে CMIE রিপোর্ট
আব্দুল করিম। পরিবারের মুখে দু’মুঠো অন্ন তুলে দিতে স্কুল ছেড়েছিলেন। ধরেছিলেন সাইকেল রিপেয়ারিংয়ের কাজ। কিন্তু তাতে কী হয়? বিভিন্ন কাজের পর আব্দুল দিল্লি শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত মিনি ট্রাকে মাল সরবরাহের একটা কাজ জোগাড় করেন। শোচনীয় দারিদ্রের জ্বালা থেকে তখন সবে মাত্র বেরনোর উপক্রম। তখনই আচমকা লকডাউনের ঘোষণা। কাজ যায় আব্দুলের। স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে ফিরে যান উত্তরপ্রদেশে গ্রামের বাড়িতে। মাসিক ৯ হাজার টাকা রোজগারও বন্ধ আজ দু’মাস পেরোতে চলল। কীভাবে পেট চলবে? আব্দুলের মতোই এই প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে এখন মরিয়া ভারতের কোটি কোটি মানুষ।
গোটা বিশ্বে প্রায় ৫ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্যের অন্ধকারে ডুবে যাবেন। এই জনসংখ্যা ২ ডলারেরও কম অর্থে দিন গুজরান করেন। অতিমারির অর্থনৈতিক ধ্বংসলীলার জেরে ভারত যে তালিকায় একেবারে প্রথম সারিতে। বিশ্ব ব্যাঙ্কের হিসেব অনুযায়ী ভারতে সেই সংখ্যাটা ১ কোটি ২০ লক্ষেরও বেশি।
বেসরকারি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক CMIE এর হিসেব অনুযায়ী, কেবলমাত্র গত মাসে ভারতে প্রায় ১২ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন দিন মজুর এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ে যুক্ত বিপুল সংখ্যক মানুষ। তার মধ্যে রয়েছে হকার, ফুটপাথে পসরা সাজানো ব্যবসায়ী, নির্মাণ শ্রমিক, রিকশ বা ভ্যান চালক।
ডেভলপমেন্ট সেক্টর কনসালটেন্সি IPE Global এর এমডি অশ্বজিৎ সিংহ বলছেন, দারিদ্র্য মুক্তির যে পথে ভারত এগোচ্ছিল, সাম্প্রতিক সঙ্কট তাকে এক ধাক্কায় আরও দূরে ঠেলে দিয়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্ট তুলে ধরে তিনি বলছেন, প্রায় সাড়ে ১০ কোটি মানুষ বিশ্ব ব্যাঙ্ক বর্ণিত দারিদ্র্য সীমার নীচে চলে যাবেন। এর ফলে ভারতের ৬০ শতাংশ জনসংখ্যা এতদিন দারিদ্র্যের অন্ধকারে ছিল, তা রাতারাতি বেড়ে হয়ে যাবে ৬৮ শতাংশ। জনসংখ্যার হিসেবে তা ৯২ কোটি! এরকম ভয়াবহ পরিস্থিতি শেষবার এসেছিল এক দশকেরও বেশি সময় আগে, বলছেন অশ্বজিৎ সিংহ।
বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্টটি প্রকাশিত হয় এপ্রিলের শেষে এবং CMIE রিপোর্ট দেয় মে মাসের শুরুতে। তারপর থেকে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকেই গিয়েছে।
ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগোর বুথ স্কুল অফ বিজনেসের রুস্টানডি সেন্টার ফর সোশ্যাল সেক্টর ইনোভেশন CMIE এর বেকারত্বের রিপোর্টকে বিশ্লেষণ করেছে। যা এপ্রিল মাসে তৈরি হয়েছে ভারতের ২৭ টি রাজ্যের ৫৮০০ টি বাড়ির উপর করা সমীক্ষার ভিত্তিতে।
গবেষকরা দেখেছেন, লকডাউনের জেরে অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে গ্রামীণ ভারত। যা ভাইরাস সংক্রমণের চেয়েও বহুগুণ বেশি। ৮০ শতাংশেরও বেশি ভারতীয় বাড়িতে আয় কমেছে এবং তার মধ্যে বেশিরভাগই সরকারি সহায়তা ছাড়া বেশিদিন টানতে পারবেন না।
সরকার কৃষকদের ঋণ, গরিব মানুষদের অর্থ সরবরাহ করার পন্থা নিয়েছে। কিন্তু সে সব কিছুই নথি থাকা মানুষের জন্য। যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দরিদ্র্যতর মানুষের নেই। ইতিমধ্যেই যে সঙ্কট সকলের আগে প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে, তা হল খাদ্য সঙ্কট। সংবাদপত্রে নিত্যই দেখা যাচ্ছে খাদ্যের অভাবে মানুষ পচা ফল, বাসি খাবার খেতেও দ্বিধা করছে না।
আগে থেকেই চাহিদার অভাবে ভোগা ভারতীয় অর্থনীতির কফিনে শেষ পেরেক হিসেবে লকডাউনকেই মানছেন অর্থনীতিবিদরা। গত ৪০ বছরের মধ্যে এই প্রথম দেশের অর্থনীতি গোটা বছর ধরে ক্রমেই কমছে। লকডাউন থেকে যখন বেরোনোর পথ খোঁজা চলছে, তখন আরও একটি চিন্তার বিষয় সংক্রমণের হারের ক্রমশ বৃদ্ধি। গোটা দেশে এখনও পর্যন্ত সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা দেড় লক্ষ পেরিয়েছে। মোদীর ঘোষিত প্যাকেজেও যে চিঁড়ে ভিজবে না, তা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। দিল্লি আইআইটির অর্থনীতির অধ্যাপক রিতিকা খেরা বলছেন, এখানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল সরকারের মানসিকতা। যা ভয়াবহ ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাঁর মতে, অতিমারি কেবল যে অর্থনীতিকে লণ্ডভণ্ড করবে, তা নয়, বরং ভারতে ইতিমধ্যেই আকাশ ছোঁয়া বৈষম্যের হারকে আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেবে। গরিব-বড়লোকে তফাৎ ক্রমেই ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়া এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা।
Comments are closed.